ভাঙ্গতে হবে শৃঙ্খলের বৃত্ত

প্রকাশ | ০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৬:৫১

কোনো দেশের মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ণয় হয় সে দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দ্বারা। আমাদের দেশের নারীদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিনিয়ত বৈষম্য-নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। বলা যায় বিদ্যমান এই সমাজ কাঠামোতে স্রোতের বিপরীতে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় নারীদের। 
 
দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের অবস্থান ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০০৮ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের মধ্যে ৭৪০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের মধ্যে ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের মধ্যে ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের মধ্যে ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের মধ্যে ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের মধ্যে ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে। গত জানুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন হয়েছে ৩৭০ জন, হত্যা করা হয়েছে ১৫২ জন শিশুকে, এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে ১০ জনকে, যৌন হয়রানীর শিকার (বখাটে উৎপাত) হয়েছেন ৮৯ জন, সালিশ-ফতোয়ার মাধ্যমে নারী নির্যাতন হয়েছে ২ জন, গৃহপরিচারিকা নির্যাতন হয়েছেন ১৮ জন, যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতিত হয়েছেন ৬৬ জন, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৩ জন, ধর্ষিত হয়েছেন ১৬১ জন। (তথ্যসূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক সংগৃহীত)। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে নারীর প্রতি অমানবিক সহিংসতা, নির্যাতন অথচ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই নিপীড়ন, নির্যাতন?

গত বছরের পহেলা বৈশাখে এক-দুইজন নয় অনেক নারীকে নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন বছর। শুধু কি বছরের ১ম দিন। বলা যায় বছরের প্রতিটি দিন আমাদের নারীরা প্রতিনিয়ত সহিংসতার কবলে পড়ছে। আজ প্রকাশ্যে ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, নিত্য নৈমিক্তিক বিষয়। এই সমাজে নারীরা না ঘরে, না বাইরে- কোথাও নিরাপদ না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই মহা উৎকর্ষের যুগেও নারীর প্রতি অমানবিক সহিংসতায় আমরা কোন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছি সেটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে ফিরে যাচ্ছি আদিম বর্বরতার যুগে। এই মানবতার লাঞ্ছনার প্রতিরোধ কি সম্ভব নয়? 

নারী নির্যাতনের কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। সেই কাঠামোর মধ্যে থাকলে নারী কোনোদিনও তার প্রকৃত মুক্তি উপলব্ধি করতে পারে না। প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার হতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা পুরুষকে করে তোলে স্বাবলম্বী, ক্ষমতাবান, কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব, মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে। আর নারীরা হয়ে উঠে ক্ষমতাহীন, পরনির্ভরশীল, অসহায়, অধিকারহীন এবং নির্যাতিতা। নারীদের যদি মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় তবে তারা নির্যাতন, শোষণ, ধর্ষণের বস্তুতে পরিণত হবে না। বর্তমানে বিরাজমান আইনে রয়েছে প্রচুর ফাঁকফোকর। যে ফাঁকের কারণে অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না। এর জন্যে প্রয়োজন কঠোর আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়নসহ ধর্ষণ-হত্যা বিরোধী বিশেষ প্রশাসনিক সেল গঠন করা। তবে একজন বা দুইজনের বিচার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে এই নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। মনে রাখতে হবে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রতিনিয়ত মহামারি আকারে বেড়ে চলছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। আজকে শিশুরাও নিরাপদ নয় এই রাষ্ট্রের কাছে।

পহেলা বৈশাখে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে। নারী নিপীড়নকারী অপরাধীদের পুলিশের হাতে তুলে দিলেও আটক করা হয়নি। পরবর্তীতে অপরাধীদের ফুটেজ সংগ্রহ করা হলে আজ পর্যন্ত অপরাধীদের কোনরূপ বিচার প্রক্রিয়ায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, পুলিশ কাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রীয় গুণ্ডাবাহিনীকে? রাষ্ট্র কেন এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল? রাষ্ট্রের এই নিরব ভূমিকার কারণে অপরাধীরা পাচ্ছে না কোনো শাস্তি। সরকারের বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ফলে এই ধরনের ঘটনা আরো ব্যাপকভাবে ঘটতে পারে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতার অভাব ও ক্ষমতাসীন সরকারের প্রশ্রয়ের কারণে। পুলিশের ভূমিকার মধ্য দিয়ে যা প্রকাশ পায় তাতে এক কথায় বলা যায়, রাষ্ট্রের চরিত্রের কারণে কমবে না নারী নির্যাতন, নিপীড়ন। বরঞ্চ দিনকে দিন বাড়তে থাকবে। রাষ্ট্রের গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে প্রতিটি সহিংসতার সুষ্ঠু বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়াতে কমছে না এই অপরাধ প্রবণতা।সরকার আর সন্ত্রাস যখন একসূত্রে গাঁথা সেখানে সুষ্ঠু বিচার কখনো সম্ভব না। রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে আজ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। রাষ্ট্র নিজেই ধর্ষক আর সন্ত্রাসীদের মদদ ও নিরাপত্তা দিচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে হত্যা, খুন, গুমের মতো ঘটনা। অস্তিত্বের সংগ্রামে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ। তাই গণআন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। 

লেখক: প্রগতিশীল নারী আন্দোলনের কর্মী, সদস্য, নারী সেল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি