বাস্তব-অবাস্তব
প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:০২ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:২৪
কিছুক্ষণ আগে একটা ভিডিও দেখে আঁতকে উঠলাম। পুরো ভিডিওটা সাহস করে দেখে উঠতে পারিনি। ভয়, রাগ, ঘেন্না হচ্ছিল। একই সাথে কোথাও একটা যেন খুব পরিচিতও ঠেকছিল। একটা মেয়ে। বয়েস খুব বেশি হলে ২০-২২ হবে। মাটিতে পড়ে কাঁদছে, কাতরাচ্ছে। আর একজন পুরুষ তার সারা শরীরের শক্তি দিয়ে একটা লাঠি দিয়ে তাকে পেটাচ্ছে। মারতে মারতে কখনো তিনি টেনে ধরছেন তার চুল। লাঠির সাথে হাত-পাও থেমে নেই মোটে। চড়-লাথির অবিরাম বর্ষণ ল্যাপটপের পর্দায় স্পষ্ট। আশ্চর্য বিষয়, মেয়েটা একবারও নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে না। ঘরের এক কোণ থেকে আরেক কোণায় ঘষ্টে ঘষ্টে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই তার শরীরকে, কিন্তু পালানোর কোন লক্ষণ দেখলাম না তার মধ্যে। উলটে দু-এক ঘা দেওয়া তো আরোই দূরের কথা।
গতকালই এক বন্ধুকে থমকে দিয়েছিলাম আমার দেশের রাজধানী, দিল্লীতে থাকাকালীন আমার সাথে ঘটা কিছু ঘটনার গল্প শুনিয়ে। তার ভয় পাওয়াটা কোন বড় বিষয় নয়। মানুষ ভয় পাবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি ভয় পেয়েছি বলেই তো ভিডিওটা শেষ পর্যন্ত দেখতে পারলাম না। প্রশ্ন হচ্ছে, ভয় আসলেই কে পাবে? কাকে পাবে? আর কেন পাবে?
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি মেয়েদের নাকি সব সময় অনেক বিপদ চারদিক থেকে ঘিরে থাকে। তাই আমাদের শেখানো হয় একা না বেরোতে, রাত-বিরেতে বাড়ির বাইরে পা না রাখতে। কিন্ত বাড়ির ভেতর, চার দেওয়ালের মধ্যেও যে সামলে থাকতে হবে, ভয়কে সেখানে ভুলে গেলে চলবে না, এমন কথা কেন কেউ বলে দেয়নি কখনো?
কলকাতায় হোক বা দিল্লীতে, রাস্তায় বেরনো মানেই জানি সতর্কতা, সাবধান। সারাক্ষণ কেউ যেন দেখছে আমায়। আনমনা হলেই জাপটে ধরবে। ভালোবাসার আলিঙ্গনে নয়। কেউ যেন সর্বক্ষণ আমার গায়ে হুল ফুটিয়ে জানান দিতে চায় মৌমাছি কে, ফুল কোনটা আর মৌচাকে কার অধিকার সর্বোপরি।
বিগত ৬ মাস ধরে ডেনমার্কে থাকি। গভীর রাতে বেরোই। একা, বা কেউ থাকে মাঝে মাঝে। জানি বাস আসবে নিয়ম মেনে। আমিও উঠব। নিরাপদ থাকাটা এখন অভ্যেসের পর্যায়ে চলে গেছে। ক্লাসে যাই, পাব-এ যাই, বাজার-হাট সব নিজে নিজেই করি। ভালো লাগে। রাস্তা পেরনোর সময় দেখি গাড়ি আসছে কি না। রাস্তা ফাঁকা হলে গটগটিয়ে পেরোই। আমি মানুষকে ভয় পাই আজন্ম। শিখে এসেছি সেটাই তোতাপাখির বুলির মতন। কিন্ত বিগত কয়েকদিন ধরে সেই অনুভূতিও কেমন একটা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি।
ভিডিওটা দেখে অনেক কিছু মাথায় ঘুরছিল। রাগ হচ্ছিল কেন মেয়েটা উলটে কিছু করল না। একটা চিৎকার পর্যন্ত না। তারপরেই মাথাটা ঘুরে অন্যদিকে চলে গেল। যখন ওই লোকটা মেয়েটাকে ছিন্নভিন্ন করছে, তখন ঠান্ডা মাথায় একজন সেটা মোবাইলে রেকর্ড করছে। সেই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে মানুষটি প্রয়োজন বোধ করেছে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করার। সেই লোকটির কাছে ভিডিও রেকর্ড করে ফেসবুকে আপলোড করার গুরুত্বের মাত্রা দেখে আমি যেন খানিক থতমত।
উদ্যত লাঠিবাহী পশু, নিশ্চুপ মেয়ে আর মোবাইল হাতে ব্যক্তির মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি পাশবিক মনে করব? যে মারছে, যে নিঃশব্দে মার খাচ্ছে? না কি যে গোটা বিষয়টা দেখছে এবং পরবর্তীতে কাজে লাগানোর জন্যে নিজের মেমরি কার্ডে ভরে রাখছে এই দৃশ্য, তাকে?
জানি এসব দেখেই ফেসবুক ছেয়ে যাবে নারীর অসীম সহ্যশক্তি বিষয়ক আদিখ্যেতায়। আমরা তো আবার নারীকে দেবী করে রাখতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করি। মানুষ হয়ে গেলেই যত ঝামেলা। ভিডিওটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এই ভিডিও যে-ই দেখবে সে কি শুধু মারা আর মার খাওয়াটুকুই দেখতে পাবে? লাখ লাখ শেয়ার হবে। কোটি কোটি মানুষ দেখবেন মার খাওয়া, মারার দৃশ্যগুলি। আর পৃথিবীর কোন এক উন্নত দেশের উচ্চমার্গীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুমে বড় বড়, কঠিন পরিভাষায় এই ভিডিওটাই হয়ত হয়ে উঠবে তৃতীয় বিশ্ব বিষয়ক আলোচনার মধ্যমণি।
কিছুদিন আগে ফেসবুক তোলপাড় হয়েছিল একটি মেয়ের জন্যে। মেয়েটির নাম শাম্মী হক। পেশায় ব্লগার, প্রাণভয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে থাকে জার্মানিতে। ভালোবাসা দিবসে ডাক দিয়েছিল বাংলাদেশের সকল প্রেমিক-যুগলদের একত্রিত হবার। রাষ্ট্রের চোখ-রাঙ্গানিকে এক একটা চুম্বন দিয়ে নস্যাৎ করে দেবার আহ্বান জানিয়েছিল সে। ইভেন্টটা আদৌ সফল বা সঠিক কিনা সে বিষয়ে যাচ্ছিনা। সেটার দরকারও নেই। মজার বিষয় হচ্ছে এই, যে ইভেন্টটা ফেসবুকে তৈরী হওয়া মাত্রই শাম্মীর দিকে ধেয়ে আসে হাজার হাজার ধর্ষণের হুমকি। জুকারবার্গের তৈরী মুক্ত জগতে বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক নেতা আরো একটি পালটা ইভেন্ট খুলে বসেন, যার মূল লক্ষ্য অর্থ সংগ্রহ করে এক ব্যক্তিকে জার্মানি পাঠানো শাম্মীকে ধর্ষণ করবার জন্যে। ফেসবুকটা সত্যিই বড় মজার জিনিস। দিল্লীর শিল্পী অরিজিত সেনের আঁকা একটি মহিলার ছবিকে সরিয়ে দিতে যেখানে মার্ক সময় নেন বড়জোর ১৫-২০ ঘন্টা, শাম্মীর ধর্ষণের আয়োজকদের বেলায় তেমন কিছুই করা হয়না। বরং প্রতিদিন বাড়তে থাকে ধর্ষকদের মাতামাতি ওয়াল থেকে ওয়ালে।
আসলে আমরা কোনদিনই মার খাওয়া ওই ভিডিওর মেয়েটার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারব না যতই মুখের বুলিতে জগৎ উদ্ধার করে চলি না কেন। তৃতীয় বিশ্বের মেয়েরা যখন মার খায় প্রতিদিন, বাড়িরে গেটের বাইরের রাস্তায় বেরনোও যখন যুদ্ধে যাওয়ার সমান হয়ে ওঠে তাদের কাছে, বুঝতে হবে যে, তখন সে আর একা প্রহৃত হচ্ছে না। হ্যাঁ, তার সর্বাঙ্গ, মনের-মাথার প্রতিটা কোষে ব্যথা সবার চাইতে হয়ত অনেকটাই বেশি। কিন্ত ঘা কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের গায়েই এসে পড়ছে। উদ্যত পৌরুষ আর বিকৃত মস্তিষ্কের হাতে ধর্ষণের শিকার আমাদের সমাজে নারী একা নয়। সেভাবেই, ওই ক্যামেরা হাতে ধরা মানুষটিও বিচ্ছিন্ন কোন জন্তু নয়। ওই লেন্সে চোখ রাখার দায়ও তাই আমার, আপনার, সবার।
আসলে মেয়েরা মানুষ হয়ে পড়ুক তা কেউই চায়না। তাদের যে শরীর বাদে আর কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে সেটাই সমাজের কাছে বড় বেশি কড়া সত্য। সেটা সহ্য করার ক্ষমতা এখনো জন্মায়নি তাদের মধ্যে। এই যে ভালোবাসা দিবসে একটি মেয়ের উদ্যোগে কিছু মানুষ ভাবতে চেয়েছেন ভালোবাসাকে মুক্ত করবেন সমাজ-রাষ্ট্রের খবরদারি থেকে, এই চিন্তাও ঠিক একইভাবে পিতৃতন্ত্র হজম করে উঠতে পারেনি। কত বড় সাহস মেয়েটার! বলে কিনা ভালোবাসবে! তাও আবার প্রকাশ্যে! প্রথমত, জনসমাবেশে মেয়েরা থাকবে এটাই তো একটা ছোটখাটো বিপ্লব। তার ওপরে সে ভালোবাসবে। তাহলেই হয়েছে আর কি।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই নাকি পাল্টায় বলে শুনেছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এক সময়ের ত্রাস, সেই কালাপানি পার হওয়াও এখন মুখের কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারনেটের ঠেলায় অজানার ফর্দ ছোট হতে হতে নিশ্চিহ্ন প্রায়। “জানিনা”- এই কথাগুলি আর কয়েকদিন পর প্রায় কোন প্রশ্নেরই উত্তর হবে না।
আমরা সব-পেয়েছি, সব-জেনেছি’র যুগের সন্তান। আমাদের মুখের দিকে উত্তর চেয়ে আছে নাকি গোটা দুনিয়া। সুকান্তকে মনে পড়ে গেল। বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী, এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। চারদিকে তাকাই আরো একবার ভালো করে। ঘর-বাড়িতে চোখ বুলাই। নতুন-পুরনো অনেক কিছুই দেখতে পাই। অনেক এগিয়েছি আমরা সত্যি। সব অস্বীকার করব তেমন গর্দভ নই। আরো এগোনোর স্বপ্নও দেখি প্রতিনিয়ত।
আমরা আজকাল নতুনভাবে সমস্ত সমস্যাকে বোঝার চেষ্টা করি। পুরনোকে পদে পদে হার মানাতে প্রস্তুত। কিন্তু সেখানেও প্রায়শই মাথানত ওই গুগলের কাছেই। একটু একটু করে নিজেদের মত করে বুঝতে থাকি। এটুকু বুঝি যে সমস্যাটা মোটেও সংস্কৃতির বা পরিবেশের নয়। সমস্যাটা রাজনীতির। যে রাজনীতি হাতে ধরে ধরে শেখায় কীভাবে নিজের ঐকান্তিক জীবনযাপনকে কায়দা করে বৃহত্তর রাজনৈতিক আলোচনার থেকে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখতে, সেটাই সমস্যার উৎসস্থল। যে রাজনীতি পর্দায় দেখা জগৎ-কে বাস্তবের সাথে গুলিয়ে ফেলতে শেখায়। যে রাজনীতি ফেসবুকের ছবিতে ‘লাইক’ মানেই পথচলতি মেয়েটির বুকে হাত দেবার অনুমতি প্রদান করে, সেখানেই রয়েছে আসল গলদ।
বিশ্বায়ন-পরবর্তী দুনিয়ায় আমরা ক্রমাগত শিখি জীবনকে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে দিতে। আমরা ক্রমেই পারদর্শী হয়ে উঠি মাথার ভেতর একটার পর একটা কুঠু্রি বানাতে। দেশ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নিবাস, লিঙ্গ, বয়স- এসব তো এতদিন এমনিই ছিল আমাদের আলাদা করে দেবার জন্যে। এই যুগ আমাদের শিখিয়েছে এই প্রত্যেকটাকেই নব নব রূপে মহিমান্বিত করে তুলতে। আর তার সাথে ফেসবুক-টুইটার তো রয়েছেই আমাদের সমস্ত না-পাওয়া চাহিদাগুলির বৃন্দাবন হয়ে। সেখানে কেউ শিকল পরানোয় নেই, কেউ বাধা দেবারও নেই। মুক্ত, সবই মুক্ত সেখানে।
যদি কামান দাগতেই হয়, এই আধা-বাস্তবতায় আচ্ছন্ন, বিচ্ছিন্ন করে রাখার রাজনীতির গোড়াতেই দাগতে হবে। এবং এক্ষেত্রে টুকরোগুলির মাঝের যোগসূত্রটা কিন্তু মোটেও ভূগোল দিয়ে ধরা যাবে না। যোগটা এখানে গড়তে হবে মানুষের সাথে মানুষের। তার চেয়েও বড় যোগসূত্র এখানে ঘরের সাথে বাইরের। এই বেড়াটা যত তাড়াতাড়ি ভেঙে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।
আরেক সাহসী মহিলা বহু আগেই বলেছিলেন, The Personal is Political.
আসল কাজটা এখন প্রতি ব্যক্তিকে বাস্তবের মাটিতে রাজনৈতিক করে তোলার। ওইটুকু হয়ে গেলে বাকিটা তো জলভাত।
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী