কবে যাবো পাহাড়ে, আহারে...

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:২৪

এলিজাবেথ গিলবার্ট এর সুদর্শন স্বামী ছিল, নিজের বাড়ি, মোটামুটি ভালো বেতনের চাকরী, সাজানো সংসার। তারপরও সে একদিন জোছনায় দেখিল কি ভূত! বারবার সে আয়নার সামনে একা। "এটাই কি আমি চেয়েছিলাম? যা চেয়েছি তাই কি আমি পেয়েছি? আমি কে? কোথায় যেতে চাই আমি?"

সিনেমায় এলিজাবেথ এর চরিত্রের জুলিয়া রবার্টস বেরিয়ে পড়ে। মধ্যবয়স্ক নারী। রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প আছে, "বিচারক"। গল্পে বিগতা যৌবনা ক্ষীরোদা মূল চরিত্র। তো বয়সটাকে বর্ণনা করা হয়েছে এরকমভাবে,
 
যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনরে ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়। তখন আর উদ্দাম যৌবনের বসন্তচঞ্চলতা শোভা পায় না। ততদিনে সংসারের মাঝখানে আমাদের ঘর বাঁধা একপ্রকার সাংগ হইয়া গিয়াছে, অনেক ভালোমন্দ, অনেক সুখদু:খ জীবনের মধ্যে পরিপাকপ্রাপ্ত হইয়া অন্তরের মানুষটিকে পরিণত করিয়া তুলিয়াছে... যাহা কিছু পাই নাই তাহার আশা ছাড়িয়া, যাহারা ত্যাগ করিয়াছে তাহাদের জন্য শোক সমাপ্ত করিয়া, যাহারা বঞ্চনা করিয়াছে তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়া-যাহারা কাছে আসিয়াছে, ভালোবাসিয়াছে... তাহাদের সুনিশ্চিত সুপরীক্ষীত চিরপরিচিতগণের প্রীতিবেষ্ঠনের মধ্যে নিরাপদ নীড় রচনা করিয়া সমস্ত আকাঙ্খার পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়...জীবনের সেই স্নিগ্ধ সায়াহ্নেও যাহাকে নূতন সঞ্চয়, নূতন পরিচয়, নূতন বন্ধনের বৃথা আশ্বাসে...নূতন চেষ্টায় ধাবিত হইতে হয়...সংসারে তাহার মতো শোচনীয় আর কেহ নাই..  

পাশ্চাত্যের নারীদের ধরণ ধারণ আলাদা। মধ্যবয়সে তার মনে হতেই পারে জীবনে কখনই শুরু করার সময় শেষ হয় না। অর্থনৈতিক মুক্তি তার ঘটেছে। এলিজাবেথ গিলবার্ট তাই বেরিয়ে পড়েন। একা। "সুনিশ্চিত সুপরীক্ষীত চিরপরিচিতগণের প্রীতিবেষ্ঠনের মধ্যে নিরাপদ নীড় রচনা" তার করতে ইচ্ছা করে নাই। তিনি বেরিয়ে পড়েন, রোমের ফুটপাতে বসে স্প্যাগেটি খান, ইনক্রিডেবল ইন্ডিয়া দেখেন এন্ড দেন ইন্দোনেশিয়া গিয়ে মেডিটেশনের কোর্স করেন। দেখা হয় তার চেয়ে সতেরো বছরের বড় ফেলিপের সাথে। ছন্দে, গন্ধে জীবন আবার কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। 

২০১০ সালের সিনেমা ইট প্রে লাভ। দেখি আর দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলি। আহা মুক্তি। কোথায় গিয়ে গলা ছেড়ে গাইতে পারবো "এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়?" এই দেশে বা শহরে সেটা কি কোনভাবে সম্ভব?

মেয়েদের ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার এ সপ্তাহের টিভিশো এর বিষয়। দুজন গেস্ট এর একজন ছিলেন প্রিয়তা খন্দকার। একটা এনজিওতে কাজ করেন, কম বয়স্ক মেয়ে, একা একা ঘুরেছেন প্রচুর। বললেন, যেটা এদেশে মূল সমস্যা হয়, বেড়াতে গেলে কি দেখছি তারচেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় আমাকে লোকে কিভাবে দেখছে। ঠিকঠাক পোশাক পড়লাম কি না, ওড়না সরে টরে গেল কি না।

গত মে মাসে কক্সবাজার গিয়ে সায়মন নামে কলাতলী বীচের হোটেলে উঠেছিলাম। ভালো হোটেল। এয়ারপোর্ট থেকে পিক, চেক ইন এর পর ওয়েলকাম ড্রিংকস, লাউঞ্জে বাঁশী আর মমতাজের গান, সন্ধ্যার পর বার ইত্যাদি ইত্যাদি। সমুদ্রের সাথে সিঙ্কোনাইজ করে সুইমিং পুল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সমুদ্রে মানুষ বিশেষ যাচ্ছে না, পুলেই ঝাঁপাঝাঁপি করছে। গরম আর আদেখলা বাঙালীর সন্তরণের নতুন অভিজ্ঞতা- এই দুই কারণেই বোধ করেছিলাম যে এই ঘটনা। পুলে মদ টদ বারণ। মানে কেউ যে সাঁতার কাটতে কাটতে কোণে রাখা ওয়াইনে রাখা গেলাসে চুমুক দেবে তা হবে না। বাংলাদেশের পর্যটনে খালি নিষেধ আর নিষেধ। যাই হোক, যা বলছিলাম। আমি মেয়েদের খেয়াল করলাম। সায়মন এর পুলে মেয়েদের দেখলাম স্বাধীন। তারা খুব পোজ মেরে ছবি তুলছে, গেঞ্জি টেঞ্জি পড়ে স্বচ্ছন্দভাবে সাঁতরাচ্ছে, ছবি তুলছে। সেই একই মেয়েদের দেখলাম সমুদ্রে যখন যাচ্ছে বিরাট বিরাট টাওয়েল জড়াচ্ছে গায়ে। পুলে মানুষজন কম তাই তারা স্বচ্ছন্দ আর সমুদ্র যত বিশালই হোক, সেখানে মানুষের সংখ্যা বেশি, ক্ষুদ্র মানসিকতার মানুষ-তাদের জন্য তার পেছনে থাকা চোখটা তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। 

এখন আপনি বলতেই পারেন, আপনি কি এমনিতে গেঞ্জি আর শর্টস পড়ে থাকেন, তাহলে সমুদ্রে বেড়াতে গেলে বা পাহাড়ে আপনারে কেন পশ্চিমরে নকল করে ঐ পোশাক পড়তেই হবে? প্রিয়তা কি বলল জানেন? গেঞ্জি আর শর্টস পড়ে আমি ঢাকায় ভিড় বাসে উঠার কথা চিন্তাও করি না, কিন্তু যখন আমি বেড়াতে যাই তখন আমার ইচ্ছা করতেই পারে একেবারে নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পড়তে। ইচ্ছা কি করতে পারে না?

আসলে পোশাক তো স্বাধীনতা। 

বা ওসব গেঞ্জি টেঞ্জি বাদই দেন। এলিজাবেথ গিলবার্টের মতো আমাদের দেশের মধ্যবয়স্ক কোন নারীও যদি চান একলা বেড়াবেন, মেডিটেশন শিখবেন, রাস্তায় বসে স্ট্রিট ফুড খাবেন-লোকে কিভাবে গ্রহণ করবে? পাশাপাশি এই ইচ্ছাগুলো কোন পুরুষের হলে কিন্তু এই প্রশ্নই মাথায় আসবে না। তসলিমা নাসরীন সেই কবে বলে গেছেন, আমি কাশ্মীর গিয়েছি শুনে বারবারই লোকে আমাকে প্রশ্ন করেছে কে কে গেছো? একা? যতবার বলি সাথে আরও কজন মেয়ে ছিল, তারা চোখ কপালে তুলে বলে, একা মেয়েরা গেলে? আর পুরুষ যখন কোথাও যায় তখন তার কতবড় বিশাল হৃদয়, সে কত প্রকৃতিপ্রেমিক ইত্যাদি বলে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় সকলে।  

তসলিমা নাসরিনের যুগ থেকে খুব একটা আগায়নি কিন্তু সমাজ। আমার দেখা একলা নারী যারা বেড়াচ্ছেন তাদের অধিকাংশই এনজিওতে কাজ করেন। যে শহরেই যান, শুরুতে তাকে এনজিওর রেস্টহাউজ খুঁজে বের করতে হয়েছে, সেটাই নিরাপদ। আমি মেয়েকে নিয়ে বগুড়া গিয়েছিলাম, পর্যটনের মোটেলে রিসেপসনে আমাকে করা প্রথম প্রশ্ন ছিল, "ভাই কই?"

"ভাই" মানে হলো সংগে পুরুষ সঙ্গী কে আছে। আমি চোখমুখ শক্ত করে বললাম, "নো ভাই বিজসেন। আমি আপা, আপাই যথেষ্ট।" 

কাজ হয়েছিল। তারা আমাকে কর্ডিয়ালি গ্রহণ করেছিল। দুটা দিন আমি আর আমার চার বছরের মেয়ে খুবই এনজয় করেছিলাম। কিন্তু যদি আমার সাথে গাড়িটা না থাকতো, সাংবাদিকতার কার্ডটা না থাকতো অথবা যদি আমি সাড়ে তিনহাজার টাকার হোটেলে উঠতে না পারতাম তাহলে কি এই আন্তরিকতাটা পেতাম? অন্য কোথাও? যে নারীর এইসব নেই তার তবে এদেশে বেড়ানোর অধিকারও নেই?   
পরিবারও আপত্তি করে একলা নারীর বেড়ানোর কথা শুনলে। সেই আপত্তিটা আসে এখন অনেকটাই নিরাপত্তার অভাব থেকেই। অন্তত: এখন তাই। শিক্ষিত এবং অর্থ আয় করেন এমন নারী পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা বের হতে চাইলে পরিবার নিরাপত্তা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথাই ভাবে। অর্থাৎ শুধুই অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটলেই নারীর ঠিক চলবে না এদেশে। পয়সা আপনার আছে, একা যান তো কুয়াকাটা, গিয়ে হোটেল ভাড়া করে থাকেন দেখি, বেড়ান দেখি যেমন ইচ্ছে পোশাক পড়ে সিবীচে।

মানে সব কথার শেষ কথা হলো দৃষ্টিভংগীটা পাল্টাতেই হবে। আর নিরাপত্তা যেমনই থাক লোকজনের চোখে সওয়ার জন্যই আমাকে আপনাকে বের হয়ে পড়তে হবে, একলা। আমরা হয়তো ঘাসের মধ্যে একলা চিত হয়ে শুয়ে জীবনে কয়টা বানান ভুল করলাম তা নিশ্চিন্তে ভাবতে পারবো না, তবে তার পথটা তো রচনা করতে হবে। যাতে জীবনের যেকোন পর্যায়ে একটা মেয়ে এদেশে পাহাড়ে, নদীতে, বনে, সমুদ্রে যেখানে ইচ্ছা বেরিয়ে পড়তে পারে। একলা থাকারও যে আনন্দ আছে, সেই আনন্দ নারীরা কোন একদিন নিশ্চয় রেলিশ করে উপভোগ করতে পারবে।

লেখক: সাংবাদিক