নারী মানেই দুর্গা, দুর্গা মানেই নারী

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:৩০

কোনো এক নারীর কথা বলবো আজ। আমরা নারীরা কত কথাই না বলতে চাই। বলতে কি পারি সব? কিংবা সব কথাই কি বলা হয়ে ওঠে? 

আজ শুভ মহালয়া। চোখের সামনে ভেসে ওঠে দেবী দুর্গার ছবি। নারীর অসীম শক্তির প্রতীক মা দুর্গা। অথচ কতটা সংসারী এক নারীর প্রতিচ্ছবি এই মা দুর্গা। চার সন্তানসহ মর্ত্যধামে পিতার আলয়ে যিনি নাইয়র আসেন। আবার নির্দিষ্ট সময় পরে স্বামীগৃহে চলেও যান। কতটা আটপৌরে সাদামাটা জীবনের ছবি ভাসে আমাদের চোখের সামনে দেবী দুর্গাকে ঘিরে। অথচ তিনিই সময়ে আবির্ভূত হন কালী বা চন্ডীরূপে। অসুরের বিনাশকারী দেবী দুর্গাই সময়ে অসীম শক্তি ধারণ করেন। এটিই নারীর প্রকৃত রূপ। সময়ে নরম, সহজ-সরল গার্হস্থ্যরূপ, সময়ে রণরঙ্গিণী। নারী বহুরূপের আধার। একই সঙ্গে শান্তি ও শক্তি, একই সঙ্গে দশভুজা ও সর্বংসহা। শুভ ও কল্যাণের প্রতিই যেন নারীর সকল আকর্ষণ, প্রবল আকর্ষণ। অশুভের প্রতি তাই তার তীব্র প্রতিক্রিয়া, চন্ডীমূর্তি। যা অসুরের মতো পুরুষরা (সব পুরুষ নয়) সহ্য করতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক মানস ও সমাজ কাঠামো যাকে প্রতিনিয়ত পদাঘাত করে। আর তখনই নারী জেগে উঠতে চায় কিংবা জেগে ওঠে। নারীসত্তা তাই সকল সময়ে অসুন্দরের বিরূদ্ধে জেগে ওঠে, নারী তাই জাগরণীয়া। দুর্গা যেন শাশ্বত নারীরই প্রতিবিম্ব। নারী আর দুর্গা তাই এক ও অভিন্ন। 

আজ কোনো এক দুর্গার কথা বলবো। যে দুর্গা ছোট্টবেলায় সবুজ-শ্যামল এই বাংলার প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াতো, সবুজ প্রকৃতিকে ভালোবাসতো। যে ফুল, পাখি, নদী ভালোবাসতো। নীলাকাশ, সাদা মেঘ, কাশবন, রাতের তারাভরা আকাশ, পূর্ণিমা চাঁদ, বৃষ্টির জল, কাগজের নৌকা, ঘাসফড়িং, প্রজাপতি, ধানক্ষেতের কাকতাড়ুয়া, পাল তোলা নৌকা, ঝিরিঝিরি বাতাস আরো কত কিযে সে ভালোবাসতো তা বলে শেষ করা যাবে না। ছোট্ট-শান্ত, লাজুক-আনমনা, একাকী নিভৃতচারী মেয়েটি সারাদিন ঘুরে বেড়াতো এদিক সেদিক সবুজ প্রকৃতির মাঝে। খুঁটে খুঁটে দেখতো সব। বাড়ির পাশে ওই বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছটায় ফুটে থাকা টকটকে লাল ফুল আর রক্তজবা তার কাছে ছিল চরম বিস্ময়। আরো বিস্ময় ছিল লজ্জাবতী গাছকে ছুঁয়ে দিলে মিলিয়ে যাওয়া পাতা। লজ্জাবতী ফুলও কি কম ভালো লাগার ছিল তার কাছে? দোলনচাঁপা, বেলি, গন্ধরাজ ও লিলি ফুলের মাতাল করা গন্ধ পাগল করে দিত মেয়েটিকে। এসব ফুলের শুভ্ররূপ তার মনটিকে শান্ত-স্নিগ্ধ করে দিত। আর শিউলি ফুলের সাদা-কমলার মাখামাখি দেখলেই মনটা ছুটে যেতো ঢাকের বাদ্যির পেছন পেছন এক দৌড়ে পূজা মন্ডপে। এভাবে ভালোই কাটছিল দিন তার। ঘরে থাকলে পুতুল খেলায় মত্ত আর বাইরে গেলে প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে খুব লাজুক আর শান্ত কিন্তু প্রচন্ড জেদী। এই জেদ অসুন্দরের বিরূদ্ধে, সুন্দর প্রতিষ্ঠার বাসনায়। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সে শরীরের সব পরিবর্তনসহ। একজন নারী সমাজের যে সব প্রতিকূলতা নিয়ে বেড়ে ওঠে সেও তাই উঠছিল। 

হঠাৎই নিজের ভেতর এক প্রবল সম্ভাবনা আবিষ্কার করে সে। এক বোধের জন্ম হয় নিজের ভেতরে। তারও ভালো লাগে অনেক কিছু। ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে সে। ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি একজন মানুষের মতো কিংবা পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের চোখে একজন নারীর মতো। একসময় হৃদয়ে ভালোবাসা জন্মায়, ভালোবাসে সে। একদিন স্বপ্নের ঘরও বাঁধে। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় সে। স্বপ্ন আর বাস্তব যে এক নয় উপলব্ধি করে সে। এ কঠিন বাস্তবতার কথা নারী কি সব সময় মুখ ফুটে বলতে পারে? ভেতরে ভেতরে দহন হয় নানা অনুসঙ্গে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণও হয় তাতে। নারীর স্বভাবসুলভ স্পর্শকাতরতায় সামান্যতম অবহেলাতেও কষ্ট পায় সে, কষ্ট পায় নানা ঘটনার ঘনঘটায়। কাঁদার মতো নরম তার মন, পাখির পালকের চেয়েও মসৃন তার হৃদয়। তবুও মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায় মেয়ে। একটু একটু প্রতিবাদী হয়। রুদ্ররূপ ধারণ করে কখনো সখনো। ভালো চোখে নেয় না পরিবার ও সমাজ। এরই মধ্যে একসময় সে মা হয়। এক জীবনে নিজের মধ্যে জন্ম দেয় আরেক জীবন। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-অবহেলায় দিনাতিপাত করে।

গড়িয়ে যায় জীবন জীবনের মতো ভাঙা-গড়া আর উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে। সামনে আর কত জীবন অপেক্ষা করছে কে জানে! কবেইবা শেষ হবে জীবন প্রদীপ তা কে বলতে পারে! শুধুই অপেক্ষা। তবুও জীবন বয়ে চলে বহতা নদীর মতো দুর্গার অসীম শক্তি গহীনে ধারণ করে। তবুও জীবন বয়ে যায় নিরন্তর অশুভ আর অসুন্দরের বিরূদ্ধে লড়াই করে। সে শুধু জানে, সুর বিনাশী যে কোনো অসুর যদি নারীর মর্যাদা ও সম্মানে এতটুকু আঘাত হানে কিংবা সত্য-ন্যায্যতা আর সুন্দরের প্রতিপক্ষ হয় তবে তখনই তাকে অসুর বিনাশী অসীম ক্ষমতাধর দুর্গারূপে আবির্ভূত হতে হবে। দুর্গা হতে হবে। মহাকালের চন্ডীরূপে উদয় হয়ে সব কিছু ভস্ম করে দিতে হবে। 

নারীর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার কাছে সব শক্তিই পরাজিত হতে বাধ্য এবং একমাত্র নারীই পারে অশুভকে দমন করে শুভ-কল্যাণ ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করতে। সুন্দরের বিজয়কেতন উড়াতে। দুর্গাপূজা প্রতি শরতে আমাদের সে শক্তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দুর্গা তো নারীরই প্রতীক। আজ যে দুর্গার গল্প বললাম, যে নারীর ছায়া তুলে ধরলাম, সেও তো দুর্গারই রূপ। অন্য দুর্গা। সংসারী এক নারী, কোমলতায় ভরা। কিন্তু প্রয়োজনে রক্তবর্ণ চক্ষু, খড়গহস্ত, রণরঙ্গীণী রূপ। অসীম শক্তিধর। এ যে নারীরই আরেক রূপ, দুর্গারই রূপ। তাই নারী মানেই দুর্গা, দুর্গা মানেই নারী।

লেখক: শিক্ষক ও নাট্যকর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত