দোষ প্রজন্মের নয়, সময়েরও নয়
প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:০৪ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬, ২৩:০৯
সময়ের সাথে বয়স বাড়ছে। সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে অবসরও। আমার অবসর মস্তিষ্কেই বিবিধ চিন্তা ভালো খেলে সাধারণত। এমনই কোন অলস দুপুরে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে ঢালাও ভাবনা-চিন্তা সাজাচ্ছিলাম, একান্তে। যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাইছিলাম কেন আমাদের সামাজিক চিন্তা বরাবরই অতীত আর ভবিষ্যতেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানের ভূমিকা কেন সেখানে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম।
একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। বর্তমান নিয়ে যারা ভাবেন, তারা মোটেও বর্তমানের জন্য ভাবেন না। বর্তমানে পা রেখে সূত্র ধরেন অতীতের। আর বোঝাতে চান, বুঝতে চান ভবিষ্যৎ। বর্তমান সেখানে শুধুই বিশেষত্বহীন সময় হয়ে থেমে থাকে। প্রাণহীন, একা।
বিষয়টা খোলসা করতে নিজেই নিজেকে কিছু উদাহরণ দিয়েছিলাম, সেই সূত্র ধরেই শুরু করি তবে।
সামাজিক বিবর্তনের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে গড়ে ওঠা প্রায় সব আলোচনায় খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েদের জীবন, অধিকার ইত্যাদি। আমার মাথার ভেতরও তো তাই হল। ভাবলাম, বিগত দশকগুলিতে আমার বয়েসের মেয়েরা যে ধরনের পোশাক পরত, সেই রীতি এখনও নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে ২০১৬-র কোন যুবতীর শরীর। আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পাব্লিক ইমেজের সাথে নাকি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে অতীতে প্রচলিত পোশাক-রীতির প্রতি আমার মনোভাব। এমন কথা আমি আগেও শুনেছি, এখনও শুনি অহরহ। লোক মুখে শোনা যায়, যেহেতু সত্তর-আশির দশকে মেয়েরা শর্টস পরে রাস্তায় সিগারেট খেত না (বা অন্তত কিছু মানুষ তা মনে করতে ভালোবাসেন, এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যুক্তি বা বাস্তবিক উদাহরণের ধার ধারেন না), শুধুমাত্র এই কারণেই আমার বা আমার প্রজন্মের এমন কাজ করা অনুচিত। অতীতে করা হত না। সুতরাং এখনও হবে না, আগামীতেও নয়। ট্র্যাডিশন। (মৃদু শ্লেষের রেফারেন্স: ফিডলার অন দ্য রুফ)।
আরো একটা উদাহরণ দিই। অতীতের ঠাকুমা-ঠাকুরদা বললে আজো বাঙালির মানসচক্ষে সাঁতার কাটেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, এবং তাঁর বেঁধে দেওয়া ঠাকুমার কাঠামো। বাঙালির সংস্কৃতি বিষয়ক আদেখলামো কোনমতেই এই ইমেজের নটেগাছটিকে মুড়োতে দেয় না। প্রজন্ম আসে, প্রজন্ম যায়। কিন্ত দক্ষিণারঞ্জন স্থির হয়ে থাকেন মস্তিষ্কে। ফ্রিজ শটের মতন। থেমে যাওয়া ক্যামেরার দৃষ্টি যেমন হাজার চাইলেও দর্শককে এগোতে দেয় না, ঠিক সেভাবেই অতীত-দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে আমাদের যাপন, যাপন প্রক্রিয়ার বর্তমান এবং তার চেয়ে আরো অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে অনাগত ভবিষ্যৎ। দৌড়ের ঘোড়ার মত দৃশ্য ছাঁটাইয়ের শিকার হতে থাকে অজান্তেই।
আরো ভাবি। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের ফেলে আসা খবরের কাগজ, শিরোনাম। সুতরাং আরো একটা উদাহরণ। এই সময় থামিয়ে দেওয়ার ফসল আমি দেখেছি কিছুদিন আগে কলকাতা শহরে এক কিশোরের মৃত্যুকে ঘিরে জন্ম নেওয়া নানা আলোচনায়। একটি সতেরো বছর বয়সী ছেলের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্ত আশ্চর্যভাবে শহরজুড়ে শুনতে পাওয়া খবরের গুঞ্জনে বারবার কানে আছড়ে পড়ে কেবলই মৃত কিশোরের দিদিমার, মায়ের পোশাক, দিদিমার গায়ের দৃশ্যমান উল্কি। অতীতের ঠানদিদির আদলের সাথে ট্যাটুর ডিজাইন না মেলাতে পেরে কিশোরের মৃত্যুর খবর ডেকে আনে আগামী প্রজন্মের উচ্ছন্নে যাওয়া বিষয়ক অমোঘ বাণীর অবিরাম বর্ষণ। নামী-অনামী খবরের কাগজ লুফে নেয় এই ছন্দপতন।
ট্যাটু আর দক্ষিণারঞ্জনকে এক পাতে ফেলতে না পারার মধ্যে কোন দোষ অবশ্য আমি দেখি না। সময়ানুপাতের চেয়ে আন্তঃপ্রজন্ম ব্যবধান বেশি হয়ে যাবার এটি নিতান্তই একটি বৈশিষ্টমাত্র। নিজের জীবন দিয়েই বুঝি দিদা-ঠাকুমা-মা-পিসিদের চেয়ে নিজের অবস্থানের দূরত্ব ঠিক কতুটুকু। আচারে-আচরণে, অভ্যাসে-অনভ্যাসে আমার চেয়ে আমার ঠাকুমা’র অনেক কাছে ঘোরাফেরা করে আমার মায়ের চিন্তাধারা। এবং এটা কোন বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। জ্বলজ্বল করে ওঠা ঘর ঘর কি কহানি। ঠিক কেবল টিভির মতই যার স্বচ্ছন্দ্যব্যাপ্তি শহর থেকে মফস্বলে।
বুঝি, দোষ এখানে কোন প্রজন্মের নয়, সময়েরও নয়। বিষয়টা নেহাতই কাকতালীয়।
আজকাল প্রায়ই আমার সাথে বাবা-মায়ের তুমুল লড়াই বাধে। আন্তঃপ্রজন্ম মতান্তরের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে কখনো কেরিয়ার, তো কখনো পোশাক-আশাক। আরো খানিকটা ভাবতে গিয়ে টের পাই, দূরত্বটা মোটেও প্রজন্মের নয়। আসলে সমস্যাটা দূরত্বের একদমই নয়। গলদটা এই আচমকা বড় বেশি কাছে এসে যাওয়ায়।
বিশ্বজোড়া বিশ্বায়ন আমার মত নব্বইয়ের দশকের আশেপাশে জন্মানো ছেলেমেয়ের নাগালে এনে দিয়েছে হাজার সম্ভাবনা, যা তার আগের প্রজন্মের কাছে ছিল রীতিমত অকল্পনীয়। একই সঙ্গে, এই যুগ আমাদের শিখিয়েছে বিবিধ দেওয়াল ভাঙার শ্লোগান। এই দেওয়াল কখনো ক্ষমতার, কখনো সভ্যতার। অত্যন্ত সাধারণ একটা উদাহরণ দিই। ছোটবেলায় আমি আমার বাবা, ঠাকুমা, পিসি-সহ প্রায় অনেককেই ‘তুই’ সম্বোধন করতাম। কেউ আপত্তি করেনি এতটুকু। আমার মা কিন্ত স্বপ্নেও ভাবতে পারত না এমন কিছু তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলিতে। মায়ের কাছে আমার দাদুর জন্য চিরকাল বরাদ্দ ছিল সামনে ‘তুমি’ আর আড়ালে ‘উনি’র সিলেটী প্রতিরূপ ‘তাইন’। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি আজও বাবাকে ‘তুই’ সম্বোধন করতেই পারতাম, যদি না আমার এমন ডাক শুনে আশেপাশে বিস্ফারিত চক্ষুর সংখ্যা সময়ের সাথে না বাড়ত। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের প্রজন্মের মাঝের ফারাকটুকুও অন্যান্য দেওয়ালের মত চোখের নিমেষে কমাতে পেরেছে নব্বইয়ের দশক। এই হঠাৎ অপ্রস্তুতভাবে মুখোমুখি হয়ে যাবার কারণে মাথায়-মাথায় ঠোকাঠুকি লেগে যাওয়া অনিবার্য। কিন্ত তবুও কে যেন একটা দেওয়াল রেখে দেয়। নতুন যুগের দেওয়াল দেখতে পাওয়া যায়না। কাঁচের যেন। অবিকল বারিস্তা বা সিসিডি’র দরজার মতন। যেখানে স্রেফ ধাক্কা খাওয়া যায়, কিন্ত অদৃশ্য।
স্যামুয়েল হান্টিংটন বা ফ্রান্সিস ফুকুয়ামাদের মতন তাবড় চিন্তাবিদেরা শুধুমাত্র বিশ্বায়ন-পরবর্তী যুগের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে ভাবিত থেকেছেন। লিখেছেন দুনিয়া কাঁপানো সব বই। কিন্ত বিশ্বায়নের ফলস্বরূপ ঘরের ভেতর জমতে থাকা এমন নিত্যনতুন সভ্যতার দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে সেই তুলনায় হইচই অনেক কম। অন্তত বাঙালির রোজকার চর্চায় সেই ভাবনার স্থান নেই বললেই চলে।
কিন্ত বাঙালি আপাদমস্তক ছাপার অক্ষরে বিশ্বাসী গোষ্ঠী। সাদা পাতায় কালো শব্দ যতটা বাঙালিকে আশ্বস্ত করে, ততটা বোধহয় শীতকালে বোরোলীনও করে না। আবার একই সাথে আমরা অসম্ভব নিয়মানুবর্তী। তাসের দেশের চরিত্রদের মতই নির্দিষ্ট স্থান, কাজ, উদ্দেশ্য বাঙালির বড্ড প্রিয়। কাঁচের দেওয়াল তাই আমাদের ভীত করে। আমরা দেওয়াল চোখে দেখতে পছন্দ করি। ছাপার অক্ষরের মতন যা হবে স্পষ্ট, নির্মোঘ। আর মানুষের যা চিরায়ত অভ্যাস; যা কিছু বোঝে না, তাকেই ভয় পেতে শুরু করে। আর যা ভয় পায়, তাকে বুঝতে চেষ্টাও করেনা। কিন্ত তারা উচ্চঘর, কংসরাজের বংশধর। বাঙালি দমে না। বুঝুক না বুঝুক, সব তর্কে শেষ ডায়লগ দেবার লোভ না সামলাতে পারা আমরা তাই নেমে পড়ি নিজেদের মত করে কাঁচের দেওয়ালকে সংজ্ঞায়িত করতে। নতুন পুরনো মিশিয়ে নানা ভাষ্য শুনতে পাওয়া যায়। কেউ বলে মূল্যবোধের অভাব, কেউ বলে অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যক্তিচেতনার কথা। আবার কেউ এটাকে স্রেফ খোলা বাজারের বৈশিষ্ট হিসেবেও বুঝিয়ে থাকেন।
কিন্ত আসলেই কি এতটা সরলীকরণ বাঞ্ছনীয়? বা আদৌ যৌক্তিক?
অনেক ভেবে দেখলাম, মূল্যবোধ বিষয়টা কেমন যেন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ক্ষীরের সন্দেশের মতন। যে যার নিজের সুবিধেমত গড়ে নিচ্ছে হরদম, নিশ্চিন্তে। একটা গোলাকার তো, অন্যটা ত্রিভুজ। একটায় গরু, তো অন্যটায় শুয়োর। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত গলাধঃকরণ বদহজম ঘটাতে পারে নির্ঘাৎ।
এই মূল্যবোধ জিনিসটা যে আদপে কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ, তা কিন্ত কোথাও কেউ ঠিক করে দেয়নি। আগেই বলেছি বাঙালি ছাপার অক্ষের বিশ্বাস রাখে। কিন্ত এবেলা এসবের অভাব পাত্তাই পায়না। তুলনায় অনেক বেশি জোরদার অতীতের পাল্লা। ঠানদিদি রেফারেন্স এখানে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে, বুঝতে হবে কীভাবে শুধুমাত্র সামাজিক অভ্যেসকে নিপুণভাবে সভ্যতার চরম সত্যে রূপান্তরিত করা যায়।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নেও নিত্যদিন ধেয়ে আসে একরাশ অস্বস্তি। সাধারণ বাঙালি শুধু নয়, বাবা-মা সহ অভিভাবক স্থানীয় সকল মানুষেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিরূপে দেখেন না। অভ্যেস নেই। ফলত, তাদের স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন অবান্তর ঠেকে তাদের কাছে। কিন্তু ভাবার বিষয়, আঠেরো পেরোনো সন্তানদেরও কি পর্যাপ্ত অধিকার থাকে মতামত রাখার, ঘরে-বাইরে সর্বত্র? নাকি কেবলমাত্র পাঁচ বছরে একবার ব্যালট-বোতাম টিপতে দিয়ে আনুষাঙ্গিক সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কতাকে আগলে রাখাটাই নিয়ম, অলিখিত রীতি। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, সমাজের নীতি-পুলিশি কিন্ত সচরাচর বয়স দেখে না, দেখতে চায় না। তার সামনে সতেরো বছরের মদ্যপ কিশোরের পাশাপাশি সমান পাপপূর্ণ ষাটোর্ধ্ব দিদিমার পোশাক। প্রাপ্তবয়স্কের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা কিশোরের লাগামছাড়া জীবনযাপন- মূল সমস্যা না দেখে অতীতের আর্কাইভ ঘেঁটে বর্তমান, ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা চালু থাকে নির্বিঘ্নে।
আসল কালপ্রিট রয়ে যায় অধরা। কেউ বুঝতেই পারেনা এতকিছুর মূলে আছে এক অসীম, অপরিচিত নতুনত্বের ভাণ্ডার। যা অবাক করে দেয় রুটিন বেঁধে দেওয়া সমাজচিন্তাকে প্রতি মুহুর্তে।
ট্যাটু মোটেও দিদিমার গায়ে একা নয়। উল্কি জ্বলজ্বল করে আছে ক্রমাগত বদলাতে থাকা পরিবার, সমাজ, সম্পর্কের সমীকরণগুলির সারা শরীর জুড়ে। তবুও চোখে পড়ে না কিছু।
অবসরের ভাবনায় ইতি টানি। নিজের দিকে তাকাই।
ভেতর ভেতর আমিও বাঙালি। বোরোলীনে অগাধ আস্থা। ঘুম ভাঙলে হাতে আনন্দবাজার চাই আমারও। বাপ-ঠাকুর্দার মতই। তবুও বুঝি সেকাল-একালের জেদীদ্বিত্ব ঘেঁটে দিচ্ছে সব কিছু।
দেশভাগ বাঙালির মেরুদণ্ড সত্তর বছর আগেই নড়াতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্ত এখন সামনে সময়ের কড়া কাঁটাতার। যা মোটা দাগে ভাগ করে দিচ্ছে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের এক্তিয়ার। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ হয়ে থমকে আছে যা কিছু বর্তমান, আর আমায় ভাবাচ্ছে নতুন প্রশ্ন।
যুগান্তরের প্রশ্নে ঘরের ভেতরকার পার্টিশন বাঙালিকে বাঁচতে দেবে তো? নাকি সেখানেও ঘোঁট পাকাতে আসবে অন্য কোন নতুন সাম্প্রদায়িকতা?
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মী
প্রথম প্রকাশ: কোরাস ব্লগ