কতদিন গার্হস্থ্য অর্থনীতি শুধুই মেয়েদের থাকবে?
প্রকাশ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:১৪ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২১:১৯
ক্লাস নাইনে আমাদের নতুন একটি সাবজেক্ট যুক্ত হয়েছিল। গার্হস্থ্য অর্থনীতি। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে হতো এই সাবজেক্টে এবং এটা রিল্যাক্সড সাবজেক্ট ছিল। বাংলা, ইংরেজি, অংক, সায়েন্সের জীববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন শেষ হলে সবাই একধরনের রিল্যাক্সড মুডে চলে যেতো। তারপর গার্হস্থ্য অর্থনীতির দিন অনেকটা পিকনিক পিকনিক ব্যাপার হতো। একটুখানি সেলাই, রান্না-বান্না করে সবাই মিলে হৈহৈ করতে করতে খাওয়া। নম্বরও এই সাবজেক্টে বেশি পাওয়া যেতো। লেটার মার্কস ধরা ছিল অধিকাংশরই। আমরা গার্লস স্কুলে পড়তাম।
আর পাশাপাশি ছেলেদের তখন কারিগরী শিক্ষার পরীক্ষায় হাতে কলমে যন্ত্রাংশ বানাতে হতো। তাদের বিষয় মোটেই রিল্যাক্সড ছিল বলে মনে পড়ে না।
এই যে গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়টাকে মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই "দুধভাত" বানিয়ে ফেলা, এটা "মেয়েলী এবং যেহেতু "মেয়েলী" তাই খুব সহজ বিষয়, ইয়ার্কির বিষয়-এইটা জাতীয়ভাবে এক রকমের স্বীকৃত। গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে যারা পড়ে তারা কেবল রান্নাই করে বা পারে এ ধরণের কথাবার্তা সমাজের অধিকাংশ পুরুষই হাসতে হাসতে বলে। ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ২০১৪ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্হস্থ্য ইউনিট হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। অন্য আরও এরকম যে দুএকটি ইন্সটিউট আছে সেখানে নারী পুরুষ উভয়ই পড়লেও গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে শুধুই মেয়েরাই পড়ে বা শূধু মেয়েদেরই ভর্তি করা হয়। আমি উইকিপিডিয়ায় কলেজের সাবজেক্টগুলো দেখলাম। খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান, গৃহ ব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ন, শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক, ব্যবহারিক শিল্পকলা, বস্ত্র পরিচ্ছদ এবং বয়নশিল্প। এই সাবজেক্টগুলো কেন শুধুই মেয়েরা পড়বে ঐ ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের মতো আমারও সেটা মাথায় ঢোকেনি প্রথমে। যেখানে নারী পুরুষের সমতার কথা বলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে গার্হস্থ্য অর্থনীতির নাম করে শুধুই মেয়েদের বাচ্চাপালন, রান্না আর সেলাই শেখানো কোন যুগের ভাবনা? এইগুলো অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু প্রয়োজন নারী পুরুষ উভয়ের। পত্রিকায় কলেজের অধ্যক্ষ্য শামসুন নাহারের বক্তব্য পড়লাম। পড়ে বুঝলাম, এইটা মূলত: মাইন্ড সেটআপ। গার্হস্থ্য বিষয়টাই হলো মেয়েদের, এরকমই ভাবেন তারা। তাছাড়া পুরো একটা পরিবর্তন আসলে ইন্সটিউটের ক্ষমতা কাঠামোরও কিছু পরিবর্তন আসবে, সেইটাও ঐ অধ্যক্ষের জন্য একটা সমস্যা।
তবে এইবার এসবের বিরুদ্ধে ছাত্রীরা দাঁড়িয়েছে। খুব ভালো হয়েছে দাঁড়িয়েছে। তারা কো-এডুকেশনের দাবী তুলেছে। খাদ্য ও পুষ্টি নারীর একার বিষয় নয়, গৃহ ব্যবস্থাপনা এবং গৃহায়ন পুরুষেরও করা উচিত, শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক নারীকে একা মেন্টেন করতে হবে-এই ধরনের ফাজলামী চিন্তাভাবনা পেছনে লাত্থি মেরেই বদলাতে হবে এমনিতে না বদলালে। তারা এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট করার দাবী তুলেছে। অধ্যক্ষ ভদ্রমহিলাকে তালা মেরে দাবীর কাগজে সাইন করিয়েছে। অনেক বছর ধরেই মুখ টিপে হাসা তারা সহ্য করেছে, এইবার আন্দোলনে নেমেছে।
আসলে পুরুষতন্ত্র থাকে প্রশাসন আর রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরেও। একদম শিরায় শিরায় থাকে। আমরা সেসব অস্বীকার করে নারীবান্ধব রাষ্ট্র, শিক্ষায় নারীর এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি গালভরে বলে থাকি আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নারীকে ভারবাহী জীব বানানোর নানান আয়োজনও করি। কারিকুলামের মধ্য দিয়ে একটা মানুষ, যে আসলে মানুষই তাকে মেয়েমানুষ বানানোর নানান আয়োজন করে। ১৯৬১ সালে এই কলেজের প্রতিষ্ঠা। টেকসই উন্নয়নওয়ালারা বলবেন, তখন দরকার ছিল। আচ্ছা মানছি তখন দরকার ছিল। এখন দরকার নাই। এখন এইসব বদলান। এই ইন্সটিউটকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদন লাগবে। সরকারের তো উচিত কোনরকম আপত্তি না করে এই অনুমোদন দিয়ে দেওয়া। লেদার টেকনোলজি, সমাজকল্যাণ ইন্সটিউটকে যেমন দিয়েছিল।
শিক্ষা মানে তো আলো। মুঠো মুঠো ভারা ভারা আলো। এই ধরনের ব্যবস্থা আর কারিকুলামে সেই আলোর মুখ কিন্তু নারীরা দেখবে না। আন্দোলনরত মেয়েদের স্যালুট। কোনকালেই কোনকিছু সহজে পায় নাই মেয়েরা। আপনারা এগিয়ে যান। আপনাদের গার্হস্থ্যশিক্ষা যদি সামান্যও আপনাদের ঘুরে দাঁড়াতে শেখায় সেইটাই আমি লাভ বলে মনে করছি। থামবেন না দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত।
লেখক: সাংবাদিক