ব্যক্তিগত ভিডিও ফাঁস পুরুষেরই চরিত্র উন্মোচন

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৯:২৮ | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২২:৪৮

সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যালের এক ছাত্রীর সাথে তার প্রেমিকের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিডিও ফাঁস হয়েছে। যা ছেলেটি ফাঁস করেছে। অনলাইনে  বেশকিছু মানুষকে(?) দেখলাম সেই ভিডিওর ডিউরেশন ৮ মিনিট ১৭ সেকেন্ড নিয়ে খুব হাসি তামাশা করছেন। 

তাদের সবার বক্তব্যে দেখলাম যে “একটা মেয়ে মানুষের সেক্স ভিডিও ফাঁস হয়েছে' বলে আলোচনা সমালোচনা চলছে। ভিডিওটাতে কেবল একজন মেয়ে মানুষই ছিলো? মেয়েটা কি একাই ডিলডো দিয়ে সেক্স করতেছিলো? আমি তো আপনাদের লেখা থেকেই জানলাম যে সেই ভিডিওতে একটা ছেলেও ছিলো । তবে ছেলেটির নাম আসছেনা কেন? কেন একজনেও বলছেনা যে 'একটা ছেলে নেংটা হয়ে তার নিজের কালো কুৎসিত লিঙ্গের ভিডিও নিজেই ফাঁস করেছে”। মেয়েদের নেংটা ভিডিও কোনভাবে ফাঁস হলেই মেয়েদের ইজ্জত যায়, কারন মেয়েরা মানুষ, মানুষ হলেই মান যাবার প্রশ্ন থাকে। 

আমাদের সমাজ ধরেই নিয়েছে যে মান সম্মান ইজ্জত এসবকিছু মেয়েদেরই থাকে কারন মেয়েরা মানুষ বলে। আর পুরুষরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কুকুরের মতো লিঙ্গ উন্মুক্ত করে প্রস্রাব করতে করতে তাদের লিঙ্গকেই কুকুরের লিঙ্গের মতো ঘেন্নাযুক্ত একটা উন্মুক্ত অঙ্গে পরিণত করে ফেলেছে। পুরুষের লিঙ্গ উদাম থাকলেও যা, ঢাকা থাকলেও তা। কারন পুরুষের কোন মান ইজ্জত থাকেনা। 
একজন মেয়ের প্রেমিক যদি প্রতারণা করে তাদের প্রেমের ব্যক্তিগত যৌনতার ভিডিও ফাঁস করে দেয় তবেই সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়বে কেন ? সমাজ কি এই ভিডিও দেখার আগে জানতো না যে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কর অর্থ কি ? এরা কি প্রেম করেছে ফাঁকা ঘরে বসে কোরআন আর গীতা পাঠ করার জন্য ? 

সমাজের এই না জানার মুখোশটা ভয়ঙ্কর। 

একজন প্রতারণা করে ভিডিও ফাঁস করলে এতে আরেকজনের ইজ্জত বা সম্মান যাবার কোন কারন দেখিনা। যদি সম্মান বা ইজ্জত যায় তবে প্রতারকের যাবে, যেই প্রেমিকা বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে ভালবেসেছে তার মান সম্মান যাবার প্রশ্নই আসেনা। যেই সমাজে বাবার হাতে মেয়ে ধর্ষনের ঘটনা মামুলি বিষয় সেই সমাজে এখনো কিছু মেয়ে পুরুষকে বিশ্বাস করে মনে জায়গা দেয়। কেবল প্রেমিকাদের এই উদারতা আর ক্ষমাশীলতার কারনেই প্রতিটি পুরুষের উচিত সকালে ঘর থেকে বের হবার সময় নতজানু হয়ে প্রেমিকার পায়ে চুমু খেয়ে বের হওয়া।

এখন সবাই বলছে ‘মেয়েটা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো, কিন্তু এবার বেঁচে গেছে’ আমি আসলে বুঝতে পারছিনা যে আত্মহত্যা আর খুনের মধ্যে তফাৎ কি। কোনটাকে আমরা আত্মহত্যা বলবো আর কোনটাকে হত্যা বলবো এটা নির্নয় করা জরুরী। কয়েকদিন আগে একজন উচ্ছল প্রাণবন্ত নারী মডেল সাবিরা আত্মহত্যা(?) করলো প্রেমিকের প্রতারণার খেসারত দিতে গিয়ে। ২০/২২  বছরের একটা মেয়ে স্বেচ্ছায় মরে গেলো? এই মৃত্যুকে আমরা আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দায়মুক্তির পথ খুঁজছি? সবার কি মনে হয় যে মৃত্যুটা একটা ইগলু আইসক্রিম? যে মেয়েটার ইচ্ছে হলো বলেই হাসিহাসি মুখে খেয়ে ফেললো?
 
সবাই যাই বলুক আমি জানি এই মেয়েদেরকে খুন করা হয়েছে। সাবিরাদেরকে খুন করা হয়। প্রভা বা শারমিনদেরকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পুরুষতন্ত্রের মৃত্যুকূপ থেকে মানসিক শক্তি আর আত্মসম্মানবোধ দিয়ে প্রভারা বেঁচে থাকে, তারা যুদ্ধ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সবাই বলছে সাবিরার মৃত্যুর জন্য ওর প্রেমিক দায়ী ছিলো। 

সাম্প্রতিক ভিডিও সন্ত্রাসের স্বীকার মেয়েটার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মেয়েটার প্রেমিক। কিন্তু আমি মনে করি অনলাইনে ভিডিও ভাইরাল করা প্রেমিক তো সমাজ সৃষ্ট একটা যৌনবিকারগ্রস্থ পশু মাত্র। এইপশুদেরকে যেমন সৃষ্টি করে দেয় আমাদের সমাজ, তেমনই জন্মের পর থেকেই সমাজ সাবিরা, প্রভা, শারমিনদের মগজে গেঁথে দেয় আত্মহত্যার হাজারটা মন্ত্র। সাবিরা ওর সাথে ওর প্রেমিকের যৌন সম্পর্ক থাকার পরেও যখন ওর প্রেমিক সেই রিলেশন ভেঙে দেয় তখনই সাবিরা ভাবতে শুরু করে ‘ওর সব কিছু শেষ হয়ে গেছে’। শারমিনের সেক্স ভিডিও বের হলেই শারমিন ভাবতে শুরু করে ‘সমাজে ওর অবস্থান নিচে নেমে যাবে’ ‘সমাজ ওকে ঘৃণা করবে’, ‘আত্মহত্যা ছাড়া ওর অন্যকোন পথ নেই’। 

অথচ মানুষের কাছে নিজের জীবনটাই হবার কথা ছিলো সবচেয়ে মুল্যবান, তার শরীর কখনোই তার সম্মান বা অসম্মানের কারন হতে পারেনা। অথচ শারমিনদের মগজে এই ইজ্জত বাঁচাবার জন্য আত্মহত্যা করার বিশ্বাস স্থাপন করে দিয়েছে কারা? 

ছোটবেলা থেকে যেই সমাজ নারীকে বলেছে “বিয়ের আগেই যৌনিচ্ছদ ছিন্ন হলেই নারী বেশ্যা হয়ে যায়।”

ছোটবেলা থেকে যেই ধর্ম নারীকে বলেছে “নারীর সতীত্ব হারালে নারীর মরে যাওয়া ভালো।”

যেই পুরুষতন্ত্র নারীকে বলেছে “ভালো নারী হতে হলে একজন পুরুষের সাথেই তুমি থাকতে বাধ্য।”

যারা প্রচার করে যে নারীর সতীচ্ছদ পর্দাছিন্ন হলে তাদের দেশকাল ধর্ম পুরুষতন্ত্র কালচার সবকিছুর জাতীয় পতাকা ছিন্ন হয়ে যায়।

এইসব ভিডিও ভাইরাল হওয়া এবং পরবর্তিতে ভিকটিমদের ভেতর আত্মহত্যা প্রবণতার জন্য তাদের কথিত প্রেমিকসহ আমাদের সমাজ ধর্ম পুরুষতন্ত্র কালচার সাবিরার মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি বিচার করতে হয় তবে সকল দায়ীদের বিচার করুন। আমার মনে হয় এদের মধ্যে সবচেয়ে কম দায়ী প্রতারক প্রেমিকটি। কারন এই সমাজ নারীকে গৃহবন্দী করে মগজধোলাই করে যেমন আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে, তেমনই সমাজের প্রশ্রয় আর আহলাদেই জন্ম নেয় এইসব প্রতারক ।

আমি একজন মানুষ । এবং অবশ্যই আমি একজন মানুষ পুরুষ। কারন পুরুষ মানুষ শব্দ যুগল আমি ঘৃণা করি। মানুষ শব্দের আগে পুরুষ শব্দটা জুড়ে দিয়ে “পুরুষ মানুষ” কথাটা আমার কাছে আপত্তিজনক। কারন “পুরুষ মানুষ” হতে গিয়ে সবাই মানুষের আগে পুরুষ হয়ে ওঠে বা হতে চেষ্টা করে। শব্দটা হওয়া উচিত “মানুষ পুরুষ” তবে যদি পুরুষেরা পুরুষ হবার আগে মানুষ হতে চেষ্টা করে।

নারী কাউকে তোমার পোশাক, শরীর বা যোনিচ্ছদ দিয়ে তোমার সম্মান বিচার করতে দিওনা।

লেখক: পরিচালক