মেয়ে কীভাবে অন্যের আমানত?
প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০১৬, ২২:৩৭ | আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০১৬, ২২:৫১
সেই শৈশবকাল থেকে অধিকাংশ কন্যা সন্তানকে তাদের বাবা মা খুব আবেগের সাথে বলে “মেয়ে তো আমার পরের বাড়ি চলে যাবে” “মেয়ে হচ্ছে অন্যের আমানত” “বাপের বাড়ি মেয়েদের নিজের বাড়ি নয়” “এখানে সে কয়েকদিনের মেহমান”
প্রিয় বাঙালি বাবা ও মা,
মেয়ে কীভাবে অন্যের আমানত হয়, যা আপনাদের কাছে গচ্ছিত থাকে, সময় হলে অন্যকে দিয়ে দায় মুক্ত হবেন, এমন চিন্তা করার পিছনে কী ধরনের যুক্তি কাজ করে? আদৌ সেটি কোনো যুক্তির মধ্যে পরে কি? যাকে আপনারা জন্ম দিলেন, লালন পালন করলেন, যার সকল সুখে দুঃখে তার পাশে থাকলেন, তাকে সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করলেন; তাকে বিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে পর করে দিলেন? কীভাবে সম্ভব? ভাল কথা মেয়েকে বিয়ে দিলেন, সে শ্বশুর বাড়ি গেলো, সংসার করলো, তাতে সে পর হয়ে যাবে কেন? মেয়ে কি আপনাদের কোনো আসবাব পত্র? কেউ ধার দিলো, সময় হলে ফেরত দিয়ে দিলেন! এক অজুহাত দেন আপনারা, “মেয়ে তো সারাজীবন বাবা মার সাথে থাকতে পারে না, তাকে অন্যের ঘর করতে হয়”
সে অন্য কারো সাথে থাকলে অর্থাৎ বিয়ে করলে সে পর হয়ে যায় না। আপনাদের বলতে আর মানতে খুব একটা খারাপ হয়ত লাগে না, কিন্তু বাস্তবিক এই কথাটি অত্যন্ত নোংরা এবং অপমানজনক। কন্যা সন্তানদের আপনি নিজের বলতে চাচ্ছেন না, শুধুমাত্র তার অন্যত্র বিয়ে হওয়ার জন্য। মেয়ের মগজে এই তথ্য ঢুকিয়ে দিচ্ছেন সে পর, সে আপনাদের “আসল” আপন না। যে বাসায় থাকছে এটি তার নিজের বাসা না। তার আপন বাসা হচ্ছে যে বাসায় সে হুট করে থাকা শুরু করছে! যেখানে যার জন্ম, যাদের রক্ত তার শরীরে বয় তারা “আসল” আপন না, আপন হচ্ছে তার শ্বশুর বাড়ি!
ঠিক তার বিপরীতে তার ভাইদের শেখাচ্ছেন তারাই বংশের বাতি, তারা আপন, বৃদ্ধ বয়সের আশ্রয়! বাপের বাড়ি ছেলেদের আসল বাড়ি! একটি পরিবারে ছেলেদের যেভাবে মুখ্য ভাবা হয় তার দশ ভাগের এক ভাগ মেয়েদের ভাবা হয় না। ছেলেদের উপর বৃদ্ধ বয়সে বাবা মা দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, ভাল কথা। কিন্তু একটি মেয়ে কি বাবা মার দেখা শুনা করতে পারে না? পারে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত বদ্ধ চিন্তা আমাদের শুধু এই চিন্তা করতে শেখায় যে মেয়ের দায়িত্ব শুধু শ্বশুর বাড়িতে! কে কোন দায়িত্ব পালন করতে পারবে কি পারবে না সেটা দেখার জন্য আগে তার উপর দায়িত্ব দিতে হবে। কিন্তু এখানে আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয়েছে মেয়ে দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য না। সুতরাং মেয়ে পর!
এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে ছেলে শিক্ষিত-প্রতিষ্ঠিত হওয়া শর্তেও বাবা মার খেয়াল রাখে না বৃদ্ধ বয়সে। তখন দায়িত্ব পালন করতে না পারা মেয়েরাই বৃদ্ধ বাবা মা’র দায়িত্ব খুব ভাল মতই পালন করে। এবং সে মেয়েগুলো বিবাহিত, সমাজের ভাষায় “নিজের” ঘর মানে শ্বশুর বাড়িতেই থেকে “পরের” ঘর মানে বাবা মা’র বাড়ির খেয়াল রাখে। সমাজ-পরিবার যে তথ্য সেই ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়; সেই তথ্য বাবা মা’র প্রতি আবেগ ভালোবাসার কাছে হার মানে। এই দায়িত্ব পালন করতে তাদের জন্য যে খুব সোজা তাও কিন্তু নয়, শ্বশুর বাড়ির নানা অকথা কুকথা শুনে সয়ে তারা তাদের বাবা মা’র জন্য করে যায়। তবু তারা প্রকৃত সন্তানের মর্যাদা পায় না। তবু পরিবার, সমাজ তাকে বলে তুমি “অন্যের আমানত”।
এমনকি বিয়ের পর মেয়েদের উপর বাবা মা’র অধিকারও অনেক কমে যায়। আমার অনেক বিবাহিত বান্ধবীদের দেখি বিয়ের আগে সব কাজে বাবা মা’র অনুমতি নিয়ে করত, বিয়ের পর বাবা মা’ আর কোনো কিছুর জন্য অনুমতি দেয় না, বলে যে জামাই বা শ্বশুর বাড়ির অনুমতি চাইতে। এমনকি সে তার বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাবে কিনা সেই অনুমতি তাকে চাইতে হবে শ্বশুর বাড়ি থেকে। তার নিজের বা নিজ বাবা মা’র অনুমতিতে কাজ হবে না!
অন্যের আমানত হিসেবে যখন মেয়েদের লালন পালন করেন, তখন শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হলে খারাপ লাগে কেন? তাকে তো আপন সন্তান ভেবে লালন করেন নি, তাহলে তার সাথে যে যেভাবে খুশি ব্যবহার করবে! কখনও ভেবেছেন নিজ সন্তানকে “আমানত” বলে পর করে দেন বলেই অন্যরা তাকে তাদের সম্পত্তি ভাবতে আগ্রহী হয়!।“আপনার হাতে তুলে দিয়েছি” বলেন বলেই অন্যরা তাকে তাদের খুশি মত ব্যবহার করতে সাহস পায়। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নিজেদের অত্যন্ত কাঁচুমাচু ভাবে উপস্থাপন করেন বলেই তারা নিজেদের আপনার মেয়ের মালিক ভাবে।
সন্তানকে সন্তানের মত ভাবতে শিখুন আগে। ছেলে আপন মেয়ে পর এই বোধ থেকে বের হয়ে এসে দুজনকেই এভাবে গড়ে তুলেন যেন কখনো কারো মুখাপেক্ষী না হয়। জীবনের প্রয়োজনে তারা বিয়ে করবে, তবে বিয়ে হলে মেয়ে পর হয়ে যায় এমন শিক্ষা থেকে নিজে বিরত থাকুন, সন্তানদেরও দূরে রাখুন। অন্য পরিবার আপনার মেয়েকে সম্মান ভালোবাসা প্রাপ্য অধিকার দিবে এই আশা করার আগে নিজেরা নিজের মেয়েকে তার প্রাপ্য অধিকার দিন , সন্তান হিসেবে, কন্যা সন্তান হিসেবে নয়। নিজেই যদি পর করে দেন তবে পর’রা আর কত আপন ভাববে আপনার মেয়েকে?
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট