আদারবক্স : পুরুষ কি চায়!
প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০১৬, ১৮:০৯
"আদারবক্স" এক বিস্ময়! খানিকটা প্রযুক্তি প্রতিবন্ধী হওয়ায় "আদারবক্স" বলে যে একটা জিনিস আছে তাই আমি ভালো জানতাম না। কদিন আগে জ্বরের কারণে অফিস লিভ নিই। এক অলস সন্ধ্যায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল ফোনের বিভিন্ন অপশন ঘুরতে ঘুরতে আদারবক্সে গিয়ে উপস্থিত হই। তারপরই গা ভর্তি করে অন্য কেউ বমি করলে যেমন অনুভূতি হয়, আমার সেরকম হলো। একবার মনে হলো, জ্বরের কারণে আমার বোধহয় ডিলেমা হচ্ছে, কিন্তু ঘটনা তা নয়। ফোন বা ম্যাসেজে মেয়েদের বিরক্ত করার অনেক উদাহরণ আছে কিন্তু সেখানেও একটা আড়াল অন্তত: থাকে। কিন্তু এখানে নাম, আইডি উন্মুক্ত। কিছু ফেইক আইডিও অবশ্য আছে। পুরুষের প্রকাশ্য পারর্ভাসন এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে কোনকিছুকেই তারা পরোয়া করে না আর।
আামি আর আমার এক বন্ধু প্রায়ই শিল্পী সালভেদর দালির একটা চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনা করি। দালি দেখিয়েছিলেন, পুরুষের চোখের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে লোলুপ জিহ্বা। আদারবক্সের ম্যাসেজ পড়ে আমার সেই চিত্রকর্মটির কথা বারবার মনে পড়ে।
এ সমাজের পুরুষেরা আসলে কি চায়? সামাজিক এই গণমাধ্যমটার কারণে পুরুষমানস দারুনভাবে জানার সুযোগ পাচ্ছি। জানছি আর বিস্মিত হচ্ছি। না হলে হয়তো জানতামই না অনেককিছু। যে সহকর্মীদের সাথে প্রতিদিন বাইরে কাজ করছি, আড্ডা আর ইয়ার্কি মারছি, চা-সিঙারা খাচ্ছি, নিউজ শেয়ার করছি- ইনবক্সেই কি অদ্ভুতভাবে বদলে যাচ্ছেন তারা। ইনবক্স আর কমেন্টে তাদের চোখ থেকে বেরিয়ে আসছে লোলুপ জিহ্বা! নারীকে ঠিক এতটা সেক্স অবজেক্ট হিসেবে দেখে এ সমাজ আর তার পুরুষেরা?
আদারবক্সে ম্যাসেজগুলোয় কি ছিল বা থাকে তা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। সম্ভবত অধিকাংশ মেয়েরাই এ ধরনের ম্যাসেজ পেয়ে এবং তা চেপে গিয়ে অভ্যস্থ। আর যেসব পুরুষ এধরনের ম্যাসেজ পাঠান তারাও জানেন কি পাঠাচ্ছেন। কিন্তু যেসব পুরুষ কখনও এধরনের ভাবনা ভাবেননি সেইসব পুরুষ সহযাত্রীদের জানার জন্য দুএকটা ম্যাসেজ নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে।
সবচেয়ে কমন ম্যাসেজ হচ্ছে, "ইউ আর স্যো সেক্সি!"
এই বাক্যটা প্রশংসা না টিজিং তাই গুলিয়ে ফেলার দশা। সম্পর্কভেদে তো এর মিনিং দাঁড়ায়। তারচেয়েও বড় কথা, আমার মতো আট/দশ কেজি ওভারওয়েট, এক বাচ্চার মাকে এধরনের বাক্য বলার মানেটা কি? উদ্দেশ্য কি? কারণ একটাই, নারীকে সেক্স অবজেক্ট ভাবা। অর্থাৎ আপনি সুন্দর হোন অসুন্দর হোন, পোশাকআশাক যাই পড়েন, বয়স যাই হোক আপনাকে মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটা এদের মধ্যে নেই।
এখন বলতে পারেন, তাহলে কি সুশ্রী, বাচ্চার মা নয় এমন নারীকে এ ধরনের বাক্য বলা জায়েজ? এ সমাজের পুরুষেরা কি কখনও ভাবে নারী কি চায়? নারীর স্পর্শকাতরতার জায়গা কোনটি? আমাকে অর্ধপরিচিত কেউ "ইউ আর স্যো সেক্সি" "সুন্দরী" "দারুণ লাগছে" এসব বললে আমি আকর্ষিত হই না। (পরিচিত কেউও এ ধরনের মন্তব্য করার অধিকার রাখেন না, ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কিত, বন্ধুত্ব বা ইয়ার্কির সম্পর্ক আছে তাদের মজা করা বা ইয়ার্কি করা অন্য কথা, কিন্তু শুধুই পরিচিত বলে এধরনের বাক্য কেউ বলতে পারেন না) কিন্তু এই অনলাইনেই এমন দুএকজনের সাথে আমার পরিচয় আছে যাদের সাথে লেখালেখি বা সমাজচিন্তা ছাড়া কোনই ব্যক্তিগত বাক্য বিনিময় হয়নি অথচ তাদের প্রতি আমি চোরাটান অনুভব করি। এখন পুরুষ হিসেবে যদি আমাকে আকর্ষিত করতে চান তাহলে আমার স্পর্শকাতরতা আর মননের চেহারা বুঝে আপনাকে এগুতে হবে। এইসব "হাই সেক্সি" "সুন্দরী" দিয়ে কিন্তু আপনি আমার বন্ধু বা অন্যকিছু হতে পারবেন না। আবার আপনি দুদিন মুখস্থ লুতপুতু রবীন্দ্রগান গেয়ে তারপর শরীরের দিকে মোড় ঘুরাবেন, সেই চালাকিও কিন্তু আমি ধরে ফেলবো। আপনার যদি দায় থাকে আমাকে আকর্ষিত করার তাহলে সেই ভাষাও আপনাকেই শিখতে হবে। আমার ব্যক্তিগত বেড়ানোর বা সাজগোজ করা একটা ছবি দেখেই আপনি লাফ দিয়ে এমন কোন মন্তব্য করতে পারেন না যাতে আমি ইরিটেট হই। আমার কোন ছবি যদি আপনার পারভার্সনকে উসকে দেয় তাহলে সেটা আপনার সমস্যা আমার নয়। পুরুষেরা তাই ছবিতে কমেন্ট করার আগে বা ইনবক্সে "আপনারে ওই ছবিতে হেব্বি সেক্সি লাগতেছে" লেখার আগে একবারও চিন্তা করে না নারীটি বিরক্ত হচ্ছে কি না কারণ নারীকে ঊন চোখে দেখতে তারা অভ্যস্থ।
হ্যাঁ আবার অনেক মেয়ে আছেন ভয়ংকর এ্যাটেনশন সিকার, তাদের সস্পর্কে কোন নিদান আমার জানা নেই। কিন্তু কে এ্যাটেনশন সিকার আর কে আসলেই সামাজিক মাধ্যমকে বন্ধুদের সাথে চিন্তা এবং সুখ-আনন্দ বা দুয়েকটি বেদনা বিনিময়ের মাধ্যম ভাবেন, এই মাধ্যমের ব্যবহারকারী হিসেবে আপনাকে সেই অ্যাটিকেট শিখতে হবে। দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, নারীকে প্লিজ আপনারই মতো পূর্ণ মানুষ ভাবতে শিখুন। সে হয়তো ওড়না পড়ে, হয়তো পড়ে না, কেউ মোটা কেউ রোগা, কারো চোখ আর বুক সুন্দর কারো হয়তো অতটা নয় কিন্তু বিশ্বাস করেন সে মানুষ। আপনারই মতো সে খেটে খায়, ওয়ার্কপ্র্রেসার নেয়, কোথাও কোথাও আপনার থেকে বেশিও সামলায়। ফেসবুকে তার একটা ফিটফাট ছবি দেখলেই চোখের মধ্যে লোলুপ জিহ্বা বার করাটা বন্ধ করেন।
লেখক: সাংবাদিক