শুয়োরের সাথে সহবাসের ফতোয়া আমরা মেনে নেইনি
প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০১৬, ০০:৩৭ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০১৬, ১২:০৯
প্রতিবছর ২৪ আগস্ট পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন রোধের আশাবাদ ব্যাক্ত করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অনেক সংগঠন। আর এই দিনটিতেই দিনাজপুরে ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কিশোরীর মা শরীফা বেগমের বুকফাটা বাষ্পরুদ্ধ কান্নায় বুকটা থেকে থেকে হাহাকার করে ওঠে।
প্রতি বছর দিনাজপুরে সর্বদলীয়ভাবে দিবসটিকে পালনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ২৪ আগস্ট দিনাজপুর শহরের প্রতিটি ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারণ ও শোক র্যালি। দিবসটি পালনে সম্মিলিত নারী সমাজ, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রতি বছর।
২৪ আগস্ট দিনটিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করার পেছনে রয়েছে এক মর্মান্তিক আখ্যান, যা তাড়িত করেছিলো এদেশের প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে।
২১ বছর আগের কথা। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। আগের দিন ২৩ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী বাসে দিনাজপুরের উদ্দেশে আসে ইয়াসমিন নামে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরী। বাসের স্টাফরা ভোররাতে তাকে দিনাজপুর-দশমাইল মোড়ে এক চায়ের দোকানদারের জিম্মায় দিয়ে সকাল হলে দিনাজপুরগামী বাসে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন।
কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর কোতোয়ালি পুলিশের টহল পিকআপ আসে। বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে জোর করে মেয়েটিকে পিকআপে তুলে নেয়। পথে কিশোরীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় মহাসড়কের গোবিন্দপুর ব্র্যাক কার্যালয়ের সামনে। এ ঘটনা কেন্দ্র করে ফুঁসে ওঠে দিনাজপুরবাসী। প্রতিবাদ আন্দোলনে ২৪ থেকে ২৭ আগস্ট দিনাজপুর ছিল উত্তাল। দেশের সচেতন মানুষ দিনাজপুরবাসীদেরকে সমর্থন জানায়। দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা উত্তাল আন্দোলন আতঙ্কিত করে তোলে খুনি ধর্ষক পুলিশ সদস্যদেরকে। আর নিজেদের বাহিনীর ভাবমুর্তি রক্ষা করতে ও অপরাধী পুলিশ সদস্যদেরকে রক্ষা করতে পুলিশ প্রচার করে যে ইয়াসমিন পতিতা ছিলো। কিন্তু পুলিশ ও রাষ্ট্রের এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচারে আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। জনতার প্রতিবাদী কণ্ঠ স্থব্ধ করতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর পুলিশের গুলিতে রাজপথেই প্রান হারান ন্যায্য বিচারের দাবী তোলা সাতজন আন্দোলনকারী। আহত হন আরও দুই শতাধিক মানুষ। তখন একজন ইয়াসমিন আর একজন ইয়াসমিন থাকেনি ইয়াসমিন হয়ে উঠেছিলো নারী নির্যাতনের প্রতিরোধ মিছিলের দীপ্তশীখা। সারা দেশব্যাপী শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন।
উত্তাল আন্দোলনের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দিনাজপুরের পুরো পুলিশ বাহিনীকে লাইনে ক্লোজড করা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার শহরের নিয়ন্ত্রণ হারান। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করে বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তারপর দেশব্যাপী আন্দোলন যখন নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হয় সরকার তখন অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর আন্দোলন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দিনাজপুরের তৎকালীন কোতোয়ালি থানার সহকারী উপপরিদর্শক মইনুল হোসেন, কনস্টেবল আবদুস সাত্তার এবং পুলিশ পিকআপচালক অমৃতলাল রায়ের ফাঁসি ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে কার্যকর করা হয়।
ইয়াসমিন এখন শুধু আর নিহত হতভাগ্য এক কিশোরীর নাম নয়। বরং সে এখন নারী নির্যাতনের এক প্রতীকের নাম। আর তাই প্রতিবছর ২৪ আগস্ট পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস।
তবে রাষ্ট্র যদি নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আন্তরিক না হয় তবে সকল প্রতিবাদ আর দিবস পালন হবে অর্থহীন। ইয়াসমিন মারা যাবার পরেও এইদেশে অসংখ্য ইয়াসমিনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু সকল খুন ধর্ষণে যেহেতু দিনাজপুরের মতো দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠেনা তাই বিচার পাবার আশাটাও কমে আসে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত নারী নির্যাতনের যে চিত্র সেটাই ভয়াবহ।
অপ্রকাশিত সকল নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সাম্প্রতিক কুমিল্লা সেনানিবাসে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হওয়া তনুর ঘটনা ছিলো সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। তনুর পরিবারসহ সমাজের সকল শ্রেণী থেকেই এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে সেনা সদস্যদেরকে দায়ী করা হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও তদন্ত কমিটির বিভ্রান্তিমূলক আচরণ বিচারপ্রার্থীদের বিচার পাবার আশাকেই মরীচিকায় পরিণত করছে দিনেদিনে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে এই লেখাটা যখন লিখছি তখন দেশে চলছে উত্তাল প্রতিবাদ আর বিচারের দাবী। কারন সেই একই, নারী নিপীড়ন। আফসানা ফেরদৌস, চব্বিশ বছর বয়সী একজন প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন, একজন সমাজ পরিবর্তনকামী স্বপ্নবান মানুষ। ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী এবং সাইক ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এন্ড টেকনোলজির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আফসানা ফেরদৌস তিন দিন নিখোঁজ থাকার পরে ফিরলেন লাশ হয়ে। ঘাতকরাই ফোন করে আফসানার মা’কে তার মেয়ের মৃত্যুর কথা জানায় এবং মেয়ের লাশ হাসপাতালে গিয়ে রিসিভ করতে বলে! ভাবা যায় বিষয়টা কতটা ভয়ংকর! একজন অপরাধী কতটা নির্ভয় আর দাম্ভিক হলে এমন আচরণ করতে পারে এটা ভাবলেই শিউরে উঠি। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের তেজগাঁও কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে দায়ী করছে আফসানার পরিবার। রবীন ও তার পরিবার একাধিকবার কল করে আফসানার মাকে আপোষ করার জন্য বলেছে, বলেছে বিচারের দাবী জানানো বন্ধ করতে। এতেই রবিনের সম্পৃক্ততা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে রাষ্ট্র পরিচালকদের একটা শাখাকে দায়ী করা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডে তখন কি এই রাষ্ট্র আফসানা হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আন্তরিক হবে কিনা? এই রাষ্ট্র চরিত্র নিয়ে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদেরকে আশাবাদী হতে দেয়না। তবুও অসহায়ের একমাত্র অবলম্বন হিসেবেই এবারও আমরা একটু আশা বাঁচিয়ে রেখে পালন করবো ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’। আর নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে বারবার আমাদেরকে দাঁড়াতে হবে রাজপথে। রাজপথে দাঁড়িয়ে আর কিছু হোক না হোক অনুভূতিহীন রাষ্ট্রকে এইটুকু জানান দেওয়া দরকার যে ‘শুয়ারের সাথে সহবাসের ফতোয়া আমরা মেনে নেইনি’। এই গ্রহণলাগা অন্ধকারে এইটুকো মানবিক আলো বেঁচে থাক।