তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও করি প্রেমের তর্জমা!
মাস্টারবেশন, অর্গাজম এবং নারীর শরীর
প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০১৬, ২০:১৯
মাস্টারবেশনের যুতসই একটা ভদ্র বাংলা শব্দ পেয়েছিলাম অনেক খুঁজে পেতে, সেটি হচ্ছে- স্বমেহন! যেটিকে বেশীরভাগ বাঙালি বলে থাকে হস্ত মৈথুন। কাঁচা ভাষায় বলে - হাত মারা। ঠিক কবে মনে নেই, তবে বয়ঃসন্ধির কোনো একদিন একসাথে কয়েকটি দেশ মহাদেশ আবিস্কারের মজা পেয়েছিলাম নিজের শরীরে। একটি ক্ষুদ্র অঙ্গানুতে আঙুল ছুইয়ে সে এক তিরতিরে অনুভূতি! তখনো জানতাম না ব্যাপারটা কি ঘটছে বা কি ঘটাচ্ছি। জানতে লাগলো কয়েক বছর।
এদেশের বেশীরভাগ পুরুষের চোখে অশ্লীল, গোপনীয়, লজ্জার বিষয়টি হচ্ছে নারীর যৌনাঙ্গ। যারা নারীর যৌনাঙ্গ বলতে শুধু ভ্যাজাইনা বা যোনীকে বোঝেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি- নারীর যৌনাঙ্গের ওপর একটি ক্ষুদ্র ত্রিকোণাকার অঙ্গ থাকে যেটির নাম ভগাঙ্কুর। নারীর স্বমেহন বা মাস্টারবেশান মূলত ভগাঙ্কুরকে ঘিরেই। এটির ওপর আঙুলের স্পর্শেই জেগে উঠতে পারে নারী শরীর, ঘটতে পারে অর্গাজম। অর্গাজমের বাংলা নাম হচ্ছে রেতঃপাত।
মানুষ মঙ্গলে বসতি স্থাপনের চিন্তা করছে, তারায় তারায় রটিয়ে দিচ্ছে তার জয়ধ্বনি অথচ নিজের শরীরের রহস্য কতোটা আবিষ্কার করতে পেরেছে? হতভম্ব হবার মতন বিষয় হচ্ছে নারী শরীরের ভগাঙ্কুর আবিষ্কার হয়েছে বলতে গেলে অনেক সম্প্রতি। রিয়াল্ডো কলাম্ব নামের ইতালীয় একজন ডাক্তার ১৫৫৯ সালে একটি ডাক্তারি বই লেখেন যার নাম হচ্ছে ‘De Re Anatonial’। বইতে তিনি ভগাঙ্কুরের কথা উল্লেখ করেন, আরও বলেন- এটি একটি সুন্দর এবং দরকারি জিনিস। এরও দুইবছর পর ১৫৬১ সালে গ্যাব্রিয়েলো ফেলোপিন্ড নামের আরেক ইতালীয় ডাক্তার দাবী করেন তিনিই প্রথম ভগাঙ্কুর আবিষ্কার করেছেন!
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় খোদ উপমহাদেশের নারীদের এই অঙ্গটি কেটে নেওয়ার প্রচলন ছিল দুইশ বছর আগেও। আফ্রিকান উপজাতিদের মধ্যে ব্যাপারটি আরও প্রচলিত ছিল। তারা নারীকে যৌন আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে এটি করতো। তবে অবাক হতে হয় যখন দেখি ইউরোপের মতন জায়গায় উনিশ শতকেও চলেছে ভগাঙ্কুর ছেদন! আরও অবাক করা হচ্ছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতন লোক বলেছেন- নারী শরীরের যোনি থেকে ভগাঙ্কুর ছেদন করা উচিত! এক্ষেত্রে তার যুক্তি হচ্ছে- নারী যদি নিজেই নিজের শরীর থেকে যৌন আনন্দ পেতে পারে তাহলে তার কাছে পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা কমবে। পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা কমে গেলে সমকাম মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠতে পারে! জীনানুক্রমে বয়ে আনা পুরুষতন্ত্র যে সিগমুন্ড ফ্রয়েডকেও ছাড়েনি তার যথার্থ প্রমাণ এটি।
প্রশ্ন উঠতে পারে নারীর অর্গাজম কি কাজে লাগে? পুরুষের অর্গাজম যেমন ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার কাজে লাগে নারীর অর্গাজম তো তেমনটি নয়। নারীর অর্গাজম না ঘটলেও নারী সন্তান ধারণ করতে পারে। সন্তান জন্মদানেও বিঘ্ন ঘটেনা। এদিকে পুরুষের অর্গাজম ঘটতে যেমন সময় নেয় দুই বা তিন মিনিট, সেখানে নারীর অর্গাজম ঘটতে সময় নেয় প্রায় পনের থেকে বিশ মিনিট। তাহলে নারীর অর্গাজমের গুরুত্ব কোথায়? অর্গাজম মানে কি শুধুই নারীর যৌনতৃপ্তি?
ব্যাপারটা আসলে তা নয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিতভাবে সফল অর্গাজম নারীর শরীরের জন্য বেশ ভালো। কেননা এতে প্রাণায়াম জাতীয় শ্বাসপ্রশ্বাস জনিত ব্যায়াম হয়, শরীরের হরমোনাল গ্ল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে অক্সিটোসিন ও প্রল্যাক্টিন উৎপন্ন হয়, হৃদপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণ রক্ত চলাচলকে গতিশীল করে। অর্গাজম ঘটা নারীর ক্ষেত্রে অক্সিটোসিনকে বলা হয় লাভ(Love) হরমোন, যা যৌবনকে দীর্ঘস্থায়ী করে, শরীর মন প্রফুল্ল রাখে, মুখের বলীরেখা পড়তে দেয়না। অন্যদিকে প্রল্যাক্টিন হরমোন অ্যাড্রেনালিনের প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখে, মাতৃদুগ্ধ উৎপাদন ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
শুধুমাত্র পুরুষ সঙ্গীর সাথে সঙ্গমে নয়, মাস্টারবেশান বা স্বমেহনে, নানারকম যোগ ব্যায়ামের মাঝেও ঘটতে পারে অর্গাজম বা রেতঃপাত। আমরা জানি মানবশরীরের বংশগতির ধারক ও বাহকের নাম ডিএনএ। সফল অর্গাজম ডিএনএ’র ক্ষয়িষ্ণু জীনগুলির মৃত্যু রোধ করে, যৌবনকে স্থায়ী করে, শরীরের বায়ো-রাসায়িক ক্রিয়ায় তৈরি ফ্রি র্যাযডিকেলস এবং নানাপ্রকার জার্মস বিলুপ্ত করে। এমনকি স্লোয়ান কেটারিঙয়ের আধুনিক গবেষণা বলছে রেডিয়েশান ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গেছে ক্যান্সার প্রতিরোধেও অর্গাজম নিঃসৃত অক্সিটোসিন বেশ বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
শেষ কথা হচ্ছে- ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর ৮ আগস্ট হলো ‘ইন্ট্যারন্যাশনাল ফিমেল অর্গাজম ডে’ বা ‘আন্তর্জাতিক নারী রেতঃপাত দিবস’। নরওয়ে, মেক্সিকো, পেরু, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, স্পেনসহ বিশ্বের নানা দেশে ছুটির দিন হিসেবে ঘটা করে পালিত হয় এই দিনটি। দিনটি উৎসর্গ করা হয় পৃথিবীর সব নারীর যৌন আনন্দ পাবার স্বাধীনতার পক্ষে। বাংলাদেশে নারীর জন্য মা দিবস, নারী দিবস, কন্যা দিবস, মাতৃদুগ্ধ দিবস পালিত হয়ে আসলেও নারীর যৌনতা সম্পর্কিত অজ্ঞতা, কুসংস্কারবোধ ও পুরুষতান্ত্রিক লজ্জাবোধ মনোভাবের কারণে এই দিবস সম্পর্কে প্রায় কেউই কিছু জানেনা। নারীর যৌনতার বিষয়টি এখানে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, অবদমিত।
নারীর অর্গাজম হচ্ছে নারী শরীরের চরম পুলকের অনুভূতি। রোগ প্রতিরোধ, টেনশান রিলিজ থেকে শুরু করে যার শরীরবৃত্তীয় ভূমিকা অসংখ্য। অথচ যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে এদেশে নারীদের কাছে লজ্জা ও অশ্লীলতাজনিত আতঙ্কের বিষয় হয়ে উঠেছে অর্গাজম।
নারী, তোমার সম্মান যোনীতে তালাবদ্ধ করে রাখায় নয়। বরং তোমার যৌনতার অনুভূতি যে অশ্লীল, নিগৃহীত, লজ্জাকর কিছু নয়- তা প্রমাণে। তোমার সম্মান তোমার জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় আর মুক্তমননে! তাই চাই- এদেশের নারীরা সঙ্গীর সাথে হোক বা নিজে, অর্গাজম নামের সুখের উঠোনে পা ফেলুক, নিজেকে বলতে শিখুক- শুভ রেতঃপাত দিবস কন্যা! জগতের সমস্ত আনন্দযজ্ঞে তোমায় নিমন্ত্রণ! নারীও অবদমনকে পেছনে ফেলে সুখের গান গাইতে শিখুক-
তোমার ভাঁজ খোলো আনন্দ দেখাও
করি প্রেমের তর্জমা
যে বাক্য অন্তরে ধরি
নাই দাড়ি তার নাই কমা!
তথ্যসূত্র
১। Eskeptic Medical Journal
২। The Daily Telegraph
৩। National Geographic magazine
৪। The Gurdian
৫। International Business Daily
৬। Patterns of Sex and Love
৭। Sacred Sex
৮। De Re Anatonial