বিদ্যানন্দ ও আমাদের কুৎসিত ধর্মানুভূতি

প্রকাশ | ০৫ মে ২০২০, ১৬:৪৬ | আপডেট: ০৫ মে ২০২০, ১৮:১৩

বিদ্যানন্দের প্রধান কিশোর কুমার দাস শুনলাম পদত্যাগ করতে চাচ্ছেন। কারণ তাঁর ধর্ম পরিচয়ের জন্য কতিপয় উগ্রবাদীদের আক্রমণ ও অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন, সংগঠন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। 'বিদ্যানন্দ'— এর মতো সুন্দর একটি নামের সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেদিনই মনে একটা কু ডেকেছিল। প্রবল অনুভূতিশীলদের টার্গেট হতে পারে। হলোও তাই। অথচ এ নামটির মধ্যে হিঁন্দুয়ানির কিছু নাই। কিন্তু মগজে আছে জীবনানন্দ, অতুলানন্দ, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ মানে তো বিধর্মী। সুতরাং বিদ্যানন্দও বিধর্মী না হয়ে যায় না। কর্ণধার হিসেবে কিশোর কুমার দাস তো আছেই।

যে দেশে সন্তান জন্মের পর বাবা মা ঘোষণা দেন খাঁটি আরবি, ফার্সি, উর্দু নাম চাই— সেখানে বিদ্যানন্দ নাম দেখে তো বিভ্রান্ত হবেই। এলার্জি শুরু হওয়ারই কথা। অথচ এই দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল মাতৃভাষার অপমান প্রতিরোধের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। রাজপথে রক্ত ও জীবন দিয়ে। ধর্মান্ধরা ভুলে যায় "যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ/ সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।" ঈশ্বর, আল্লাহ তো তাদের মতো নির্বোধ নন, তিনি সকলের ভাষা বুঝেন। বুঝে না শুধু অবোধেরা।

বিদ্যানন্দ— নামটি একজন মুসলমান ব্র্যান্ড এক্সপার্টের দেয়া। যার মূল প্রতিপাদ্য আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন। একটা অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বিদ্যানন্দের সঙ্গে জড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠরাই মুসলমান। বিদ্যানন্দের ফান্ডে দানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠরাই মুসলিম। খুব ছোটবেলা থেকেই কেন জানি একটা স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষা পেয়েছিলাম কারো নাম দেখে ধর্ম পরিচয় সম্পর্কে কৌতুহলী না হওয়ার। এজন্য নিজ ধর্ম পরিচয় সমুন্নত রেখেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতায় ধর্ম পরিচয় কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠেনি। গৌণই থেকেছে।

যা হোক, সেই বৃটিশ ভারতে, প্রবল পাকিস্তান আন্দোলনে, চব্বিশ বছরের শোষণের কাল থেকেই আমরা একটা ধর্মান্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ছিল এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার রাষ্ট্র ঘোষিত সচেতন প্রচেষ্টা। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ক্ষমতালোভী চরিত্রহীন বুট ও বন্দুকওয়ালা রাষ্ট্রপ্রধানরা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে শতাব্দীর গভীর অন্ধকারে। গণতান্ত্রিক শাসনামলেও এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আমাদের শাসকেরা। নিজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মননের সুন্দর একটি ক্ষেত্রও আমরা আর তৈরি করতে পারলাম না। তাই আর্ত মানবতার কাজে নিয়োজিত স্বচ্ছ একটি সংগঠন নিয়েও নষ্টদের ঘৃণা বিদ্বেষ নানাভাবে প্রকাশ হতে দেখে অবাক হই না।

পৃথিবী যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত তখনও আমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। এ থেকে সহজে নিস্তার নেই। ধীরে ধীরে এভাবেই সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা সাম্প্রদায়িক অমানুষের সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি। যেখানে মানুষের কর্ম নয়, ধর্ম পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত একটি তরুণও মৌলবাদের মোহন মিছিলে যোগ দেয় অবলীলায়। অথচ এদেশে বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদের মতো, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, জোড়বাংলার মন্দির বেদি, আউল-বাউল আর মাটির দেউলও সত্য। আরও সত্য, সুন্দর ও মানবিক ঘোষণা "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।"

বিদ্যানন্দ সংগঠনটি করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি মানুষকে সহযোগিতা করেছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। তবু ঘৃণার চাষবাসে বেড়ে ওঠা ধর্মান্ধরা সংগঠন ও ব্যক্তি কিশোরের বিপক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছেই। এদেশে কিশোর কুমারের মতো উদ্যমী স্বাপ্নিক তরুণেরা অন্ধকারে আলো ও আশা জাগাচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, দেশটা রহিম, করিমের যেমন তেমনি কিশোর দাসেরও। অসাম্প্রদায়িক মানবিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য সকলের পূর্বপুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তারপরও নিজ ভাষা ও পরিচয় সম্পর্কে শত শত বছর ধরে কুণ্ঠিত ঘৃণাজীবীদের উদ্দেশ্যে অষ্টাদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম তো বলেই গেছেন —


"যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।... দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।"

লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক