ঠিক কী কী করলে নুসরাত বাঁচতে পারতো!
প্রকাশ | ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:০৫ | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ১৯:১৭
যে মেয়েটির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, ওর শ্বাসনালীও পুড়ে গেছে। মেয়েটি বাঁচবে বলে মনে হয় না। শতকরা ৭৫ ভাগ দগ্ধ হলে বাঁচবার সম্ভবনা প্রায় শূণ্যের কোঠায়। বাঁচলেও, পংগু অথর্ব হয়েই থাকবে।
মেয়েটিকে যেখানে ওরা পুড়িয়েছে, সেটি একটি মাদ্রাসা। ঘটনা ঘটেছে ছাদে। নিচেই পরীক্ষার হল। প্রস্তুতি চলছিল পরীক্ষা গ্রহণের। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রী শিক্ষক কর্মচারীসহ বহু লোকের উপস্থিতিতে ঘটনা ঘটেছে।
মেয়েটিকে যারা পুড়িয়েছে তারা মেয়েটিরই শিক্ষক, সহপাঠী।
মেয়েটিকে যার কারণে পোড়ানো হয়েছে, সেই লোকটি মেয়েটির মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। লোকটির নাম সিরাজ উদ দৌলা।
মেয়েটিকে যে কারণে পোড়ানো হয়েছে, সেটি এটি পুরোনো আদিম কারণ। মেয়েটির শরীর। অধ্যক্ষের খায়েশ জেগেছিল মেয়েটির শরীরের প্রতি। অতএব সে তার ঘরে ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে অশ্লীল প্রস্তাব দেয় এবং যৌন হয়রাণি করে।
বরাবর যা হয়ে থাকে, এসব ঘটনা মেয়েরা লুকায়। সে না লুকালে তার পরিবার লুকায়। এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম ঘটেছে। মেয়েটির পরিবার থানায় গিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছে ওই অধ্যক্ষ লোকটির বিরুদ্ধে। শ্লীলতাহানির মামলায় অধ্যক্ষকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। এবং এরপরই শুরু হয়েছে আসল খেলা।
মেয়েটিকে ও তার পরিবারকে নানাভাবে হুমকি ধমকি দেয়া হয়েছে প্রথমে যেন মামলা তুলে নেয়া হয়। সেটি করতে না পেরে সিরাজ উদ দৌলার অনুসারী কয়েকজন মিলে মেয়েটিকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়েছে। প্রথমে বলেছে সে যেন মামলা তুলে নেয়। মেয়েটি জবাব না দিলে তারা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলেছে। এরপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আগুন দেয়া লোকজনের পরনে ছিল বোরখা। অর্থাৎ পরিচয় লুকাতে তারা বোরখা পরে এসেছে। তারা মিথ্যে বলে মেয়েটিকে ছাদে ডেকে নিয়ে যায়। মেয়েটির নাম নুসরাত জাহান রাফি। সে ফেনীর সোনাগাজীতে ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে আলিম পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। মেয়েটির বয়স আঠারো।
মেয়েটিকে নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। এখন মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে নীরব হয়ে যাবে কিছু পরেই। এইসব দৃশ্য দেখে দেখে আমাদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে। আমরা যারা এসব দেখছি, তাদের গায়েও নিত্য জ্বলছে আগুন। আমাদেরও পুড়ে গেছে শরীরের ষাট সত্তর কি আশি ভাগ। বুকের ভেতরে পুড়ে গেছে নব্বই শতাংশ। আমাদের আত্মা, আমাদের হৃদয় পুড়ে পুড়ে এখন শুধুই পোড়া কাঠ। আমরা যারা তাকিয়ে আছি ওই মেয়েটির ব্যান্ডেজ বাধা সর্বাঙ্গের দিকে, তারাও নিত্যদিন বহন করে চলেছি আগুন। এ আগুন জন্মের সময়ই আঁতুর ঘরে দেয়া হয়েছে আমাদের মুখে। এরপর মৃত্যু অবধি আগুন বয়ে নিয়ে চলেছি।
এ সমাজে যেকোন মেয়েকে যেকোন পুরুষ যত্রতত্র যেখানে সেখানে যেভাবে ইচ্ছে অশ্লীল প্রস্তাব দিতে পারে। হোক সে বড় সরকারি কর্মকর্তা, হোক সে শিক্ষক, হোক সে প্রকৌশলী, হোক সে মন্ত্রী, হোক সে চিকিৎসক, হোক সে সাংবাদিক, হোক সে সুইপার, হোক সে কৃষক, হোক সে কেরানী। যে কোন মেয়েকে দেখে যে কোন পুরুষের জৈবিক ক্ষুদা জেগে উঠবে এবং সেটি শীতল করতে মেয়েটিকে তার প্রয়োজন হবে। এখানে নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যাপার নেই। এ সমাজে প্রতিটি পুরুষ উদগ্র যৌনক্ষুদা নিয়ে ফিরে চলে বেড়ায়। এবং এই ক্ষুদা মেটাবার জন্য তাদের সামনে নারী নামের খাদ্যের মূল্য এতই সস্তা যে সরবরাহে কোন ধরণের বাধা এলেই পুরুষ হয়ে ওঠে বিচলিত, অস্থির, উত্তেজিত এবং সরবরাহ নিশ্চিত করতে যেকোন কিছু করে ফেলতে প্রস্তুত।
নুসরাতের বাঁচার আশা ক্ষীণ। ভাবছি, ঠিক কী করলে নুসরাত বাঁচতে পারতো!
অধ্যক্ষের প্রস্তাব মেনে নিলে? তার কাছে শরীর সমর্পণ করলে? তার বিরুদ্ধে করা মামলা উঠিয়ে নিলে? অধ্যক্ষ ও তার অনুসারীদের কথামত চললে? ঠিক কী কী করলে একটি নারী একটি বীভৎস সমাজে বেঁচে থাকতে পারে? পুরুষকে কতটা তৃপ্তি দিয়ে, কতটা আত্মসমর্পণ করে? কতটা বিকিয়ে দিয়ে? নিজেকে কতটা নিঃস্ব করে আর জড়’তে পরিনত করে?
নিজেকে কীভাবে বিকিয়ে দিয়ে?
চিকিৎসকরা বলছেন, নুসরাতের জীবন এখন চরম সংকটাপন্ন। আমি বুঝিনা ডাক্তাররা কেন এখন এটি বলছেন! নুসরাতের জীবন তো সেই আঠারো বছর আগেই সংকটাপন্ন অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছে। ঠিক যেমন আমার যাত্রা শুরু হয়েছে আমার জন্মমুহুর্ত থেকে। যেমন আমার মায়ের, আমার বোনের, আমার আত্মীয়, বন্ধু সহকর্মী প্রতিটি মেয়ের। এই দেশে মেয়ে তো মৃত্যু মুখে নিয়ে জন্মায়। এই দেশে মৃত্যুই সত্য প্রত্যেক মেয়ের জীবনে। জীবন বলে তাদের জীবনে প্রকৃত অর্থে কিছু নেই।
নারী নির্যাতন আর নারী অবমাননার একের পর এক ঘটনা আমাকে ক্লান্ত করে। বিষাদিত করে। অবসাদে পায়। সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো নুসরাতের শরীর দেখে আমি শ্বাস ফেলি। তারপর ভুলে যাবার চেষ্টা করি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর অপশাসন যে দেশে নির্যাতক, শোষক, দুষ্কৃতিকারীকে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যাবার দুঃসাহস দিয়ে সমাজে অধিষ্ঠিত থাকার সুযোগ করে দিয়েছে, আমাদের প্রতিবাদ যেখানে দুর্নীতির দেয়ালে গিয়ে বারবার আছড়ে পড়ে, সে দেশে আর কতবার লিখতে হবে এইসব প্রতিবাদলিপি? কী হবে লিখে? নুসরাতের সাদা ব্যান্ডেজ আর শতকরা আশি ভাগ পোড়া শরীরের মতই আমাদের মূল্যহীন প্রতিবাদের পাতাগুলো ঢেকে গেছে পোড়া দাগে। আমাদের প্রতিবাদ শুয়ে আছে মুমুর্ষু। আমাদের আত্মা আজ মৃতপ্রায়। আর কটা দিন পরেই মৃত্যু এসে ডেকে নিয়ে যাবে।
প্রকাশ্য দিবালোকে একটি মাদ্রাসার ছাদে তুলে একটি আঠারো বছরের মেয়েকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া আজ এত সহজ- এই কথাটিই বারবার আজ অবসন্ন করে দিচ্ছে। এর আগে খাদিজা, এর আগে তনু, এর আগে পূজা, এর আগে রত্না, এর আগে সাবিহা…আহা কত কত নাম। কত কত রক্তপাত। ঝরেই যাচ্ছে। কার অলক্ষ্যে? কার অগোচরে? সূর্যের নিচে! সতেরো কোটির ঘনজঙ্গলে! আমাদের ঘিরে থাকা এই মানুষেরা তবে কারা? এই শাসকের দল তবে কাদের? এই গণতন্ত্র তবে কার কথা বলে? এই সুশাসনের গল্প তবে কে রচনা করে?
নুসরাতের জন্য প্রার্থনা করি, যেন সে শান্তিময় মৃত্যুর ওইপাড়ে চলে যায় দ্রুত। বেঁচে থেকে লাভ নেই। প্রয়োজনও নেই। এই পোড়া দেশে শরীরময় তীব্র আগুন সমেত আমরাও খুব শিগগির মিলিত হব তার সাথে। জন্মমুহূর্তে পাওয়া এ আগুন নিয়ে জীবন জুড়ে বারবার আগুনের ট্রায়াল দিয়েই চলেছি। কোন না কোন দিন এর শেষ তো হবেই। নুসরাতের মত করেই।
লেখক: লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা
সূত্র: sharminshams.com