নারীবাদ নিয়ে আবহমান কালের বাহাস

প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৯, ২১:৩১ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯, ২১:৩৫

এই তর্কটা নতুন কিছু নয়। শুরু হয়েছিল 'উইম্যান চ্যাপ্টার' থেকে। এইখানে যারা লেখালেখি করেন তাদের ফেমিনিজম হয় না, তারা অশিক্ষিত, মূর্খ, কিটিবাদী, এলিট, শরীর দ্যাখানো ইত্যাদি বলা শুরু হলো। সাধারণেরা সম্পাদক সুপ্রীতি ধরকে বলল, “মাসিক বন্ধ হওয়া বেশ্যালয়ের মাসী” আর এর লেখকদের বেশ্যা। এখানে পিরিয়ড, ব্রা, পেন্টি ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখির সমালোচনা হলো এইভাবে যে- এইসব লিখে লিখে কতদূর নারীবাদ হবে আপনাদের? এই প্রশ্ন কি শুধু গড় পুরুষেরা করেছিলেন? না, সমাজের অসংখ্য প্রগতিশীল পুরুষ, যারা বছরখানেক আগেই শাহবাগ মুভমেন্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যুক্তিবাদী নাস্তিক থেকে শুরু করে কবি, লেখক এবং নারীরাও এইসব প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা ওই পোর্টালটির লেখকেরা প্রায় দিশেহারা হয়ে কিভাবে এইসব প্রশ্নের মোকাবিলা করবো তা ভেবেছি, কিভাবে আমাদের নারীবাদী অ্যাক্টিভিজম সহী নারীবাদ হিসেবে গণ্য হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা করে লেখালেখি করেছি। সমাজের যে মেয়েটি কোনওদিন মাথা তুলে কথা বলতে পারেনি, সে যখন তার যন্ত্রণা আর বেদনার কথা বলেছে এই পোর্টালে- সেই পোর্টালটিকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আবার এই পোর্টাল সম্পাদকই যখন গৃহকর্মী আর বাথরুমে গণেশ রাখা নিয়ে অস্বচ্ছ, সাম্প্রদায়িক এবং অসম বক্তব্য দিয়েছেন- আমরা দলবেঁধেই বলতে গেলে তার প্রতিবাদও করেছি। এই পোর্টালে অনেকের মতের বিরুদ্ধে গিয়েও লেখা বন্ধ করে দিয়েছি।

কিন্তু আমাদের দোষ তাতে কোনওদিন কাটেনি। মূল সমস্যা হলো নারীবাদে, নারীবাদীদের নিয়ে- এখানে পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীদের কাছ থেকে যুক্তিবাদিতা প্রত্যাশা করাটা ভুল ছিল। দোষ কাটানোর জন্য আমরা পোর্টালটিতে লেখা বন্ধ করেছিলাম তা আবার কেউ ভেবে বসবেন না, যা ঠিক মনে হয়েছে, ন্যায় মনে হয়েছে আমরা তাই করেছি।

তো যা হোক তখন থেকেই ঘুরেফিরে এইসবই চলছে। কদিন পরপরই 'নারীবাদী'রা মূর্খ, শুয়ে বেড়ানো, স্বামী ঠকানো, তৃণমূলের নারীদের কথা না শোনা, কিটিবাদী…এইসব বলে বলে পুরুষেরা এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীবাদীরা অর্গাজমের সুখ পায়।

সম্প্রতি অর্জয়িতা রিয়া, ফাহমিদা জামান এবং নাদিয়ার বাহাস নিয়েও অনেকে মজা পাচ্ছেন। মজা পাওয়ার এই সংস্কৃতিও কি যে অসুস্থ! একটা মেয়ে শরীর দ্যাখাচ্ছে তাকে আপনি সাপোর্ট না করতে পারেন, তারে নারীবাদী মনে না করতে পারেন কিন্তু সে নারীবাদী না এইটা বলার এখতিয়ার রাখেন না- এইটা হলো নাদিয়ার পয়েন্ট। আমি তার পয়েন্টের সাথে একমত। এখন এই পয়েন্টে একমত হলে কি কি অভিযোগ আসে?

১. আসল নারীবাদ বাদ দিয়ে তিনজনের ঝগড়া নিয়ে পড়ে থাকা
২. শরীর দ্যাখানো কি নারীবাদ? যদি না হয় তাহলে ফাহমিদাকে কেন ডিফেন্ড করা হচ্ছে?
৩. ইউরোপীয় ওয়েভ এর নারীবাদ এদেশের প্রেক্ষিতে চলে না এইটা আমরা বুঝি না
৪. নাদিয়ারে আপনারা পীর মানেন, কেন?

তৃতীয়টা দিয়ে শুরু করি। যারা বলেন ইউরোপীয় ওয়েভ এইখানে চলে না, কেন বলেন? ইউরোপীয় থার্ড ওয়েভে পাবলিকলি পিরিওডের রক্ত ছিটানো, ব্রা অফ অ্যাকটিভিজমের অংশ হিসেবে এইসব আছে। তো আমাদের দেশের শহর এবং গ্রামের নারীদের এইসব বিষয় কি ইতিমধ্যেই মীমাংসিত? তাদের প্রতি নীপিড়ন, ধর্ষণ, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, ভিড়ভাট্টা আর কর্মক্ষেত্রে হয়রানি এইগুলো বন্ধ হয়ে গেছে? তো যারা উইম্যান চ্যাপ্টার আমলে বলছিলেন, ব্রা পেন্টি দিয়ে কতদূর নারীবাদ হবে, ব্রার ফিতা দেখা গেলে যে এখনও যেন বিষাক্ত সাপ দেখছে অথবা জিভে জল আনা কোন ফল…পুরুষদের এই মনোভাব বদল হয়েছে? এইসব নিয়ে লেখালেখি যে মূলত ট্যাবু ভাঙতে চাওয়া, পিরিয়ড শরীরের একটা স্বাভাবিক বিষয় এইটা বলতে চাওয়া- এইটুকু বোঝার বুদ্ধি কি আমাদের সমালোচনাকারীদের নেই? হ্যাশট্যাগ মি টু উন্নত বড়লোক দেশ থেকে আসছে এখন এইটা আমাদের প্রেক্ষিতের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

দ্বিতীয়ত, এলিট নারীবাদ বলে একটা টার্মের জন্ম হয়েছে। আমি বুঝতেই পারি না, আমার টাকাপয়সা আছে, নিজের আয়ে চলতে পারি, ভালো ভালো কাপড়চোপড় পরতে পারি তাই বলে কি আমার কোনও দুঃখ নাই? থাকতে পারে না? রুবাবা দৌলা বা সেলিমা আহমেদ বা গীতি আরা সাফিয়া হকের কি কোনও সংগ্রাম নাই? বেদনা নাই? তারা কি কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে ট্রিট হয়েছেন সর্বদা? যে যেই ক্লাসে বিলং করে সেই ক্লাসে বসে সমতার কথা বললে কেন তারে খারিজ করা হবে? হোয়াটস রং?

তৃতীয়ত, এই যে এলিট বলা হয় যাদের তাদের নাম কিন্তু বলা হয় না। আমি খুব আশা করি এরপর যারা লিখবেন, তারা একদম নাম ধরে ধরে, এরা যে গরীব, চা শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, গৃহকর্মী নারীদের কথা বলে না তার প্রমাণ দেবেন। কে লেখে নাই? সাদিয়া নাসরিন? তিনি প্র্যাকটিসিং নারীবাদী, তৃণমূলে পেশাগত সূত্রেই তার কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। (তিনি ভালো ভালো শাড়িও পরেন।) মুনমুন শারমিন শামস? এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না, এক গৃহকর্মী নিয়ে তার অসাধারণ একটা গল্প আছে। (তিনিও ভালো ভালো শাড়ি পরেন) বীথি সপ্তর্ষী? তিনি সংগঠনই করেছেন জেলায় জেলায় প্রান্তিক নারীদের নিয়ে। (তিনিও সুন্দর করে পোশাক পরেন।) মার্জিয়া প্রভা? তার কাজ সর্বজনবিদিত। (তিনিও সাজতে পছন্দ করেন।) আবার নাহিদ আপা একেবারেই না সেজেও এলিট! আমার টেলিভিশন ক্যারিয়ার দুদিনের নয়। ১৩ বছরের। অসংখ্য রিপোর্ট আমি করেছি প্রান্তিক নারীদের নিয়ে, এখন যে শোটা আমি করি অন্যপক্ষ- তাতে সবসময় সচেতনভাবে আমি প্রান্তিক নারীদের কথা বলি। রিসার্চ করে তাদের সমস্যা বের করে কাজ করার চেষ্টা করি।

উল্লেখিতরা ছাড়াও অনেক নারীবাদী আছেন যারা প্রান্তিক নারীদের কথা বলেন। (আমি আশা করি যারা এলিট নারীবাদীদের নিয়া রঙ্গতামাশা করেন তারা সেইসব নারীবাদীদের নিয়েই করেন যারা প্রান্তিক নারীদের কথা বলেন না। তাদের চেনার খুব ইচ্ছা আমারও।) এখন সৌদী থেকে ফিরে আসা নারীর বেদনা লিখতে বা বস্তির স্বামীর হাতে বেধড়ক পিটানী খাওয়া নারীর বেদনা লিখতে অথবা গার্মেন্টস এর সূর্য না দেখা নারী শ্রমিকটির বেদনার কথা লিখতে কে কবে কোথায় কার্পণ্য করেছে?

জ্বী বলতে পারেন, যতটা আপনি নিজের কথা লিখছেন ততটা রহিমা বা মালেকার কথা লিখছেন না। লিখতে হলে ওদের কথা বেশি বেশি লিখতে হবে। এইটা ভালো এবং দরকারী পরামর্শ। যেই পরামর্শ দিলশান আরা পারুল দিয়েছেন। কিন্তু জেনারেলি “কেউ আপনারা এদের কথা বলেন না” বলে উড়িয়ে দিলে সেইটা মানা হবে না। আমরা যদি সমতার পৃথিবী চাই, পুঁজিবাদের কারণে তৈরি হওয়া এইসব অসমতা আমাদের আরও বুঝে অ্যাক্টিভিজম করতে হবে- এই কথা বলতেই পারেন। ফেইম সিকিং এর জন্য যে নারীবাদ সেই নারীবাদ মুর্দাবাদ বলতে হবে। বলবো আমরা। বলছি আমরা।

শরীর দ্যাখানো এখানে এখনও এতো ট্যাবু! একটা মেয়ের পায়ের ছবি দেখলে পুরুষের মাথায় মাল ওঠে। এখন কোনটা লিবারেলিজম আর কোনটা না- সেইটা তো কেউ বলে দেয়ার এখতিয়ার রাখে না। আপনার মাথায় মাল উঠলে অথবা আপনি শরীর দ্যাখানোওয়ালাদের মতো পোশাক না পরতে পারলে সেই কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব আপনার, দেখতে ইচ্ছা না করলে দেখবেন না কিন্তু তার জন্য তারে খারিজ করবেন কেন?

নাদিয়ারে পীর মানে অনেকে- এই কথাতেও নিউজ ফিড ভেসে যায়। নাদিয়া নিজে পীরালি ব্যবসা খোলে নাই। সে কাউরে কোনওদিন বলে নাই, আমারে সাপোর্ট করো। এই যে তার দম আছে, এই যে সে সব কথা নির্দ্বিধায়, অপ্রতিরোধ্যভাবে বলে যায়, এই যে সে আমাদের মতো প্যানপ্যান করে না এইজন্য তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। নাদিয়া ইসলাম হলো তাই- অধিকাংশ বাঙালি নারীবাদী নারী যা হতে চায় কিন্তু হতে পারে নাই বা পারবে না। এই থেকে যে ঈর্ষাকাতরতা তা দেখলে আমার মজা লাগে।

নাদিয়ারে যুক্তিযুক্ত কারণে যারা খারিজ করেন বা অপছন্দ করেন তাদের প্রতিও কিন্তু আমার সমান শ্রদ্ধা।

নারীবাদকে যার যার ফ্রেমে বা ছকে ফেলে দেখার যে রেওয়াজ বা প্রবণতা সেইটা থেকে আপনারা বের হয়ে আসেন। কি করলে, কিভাবে করলে পুঁজিবাদ নিপাত গিয়ে সবার মধ্যে সমতা আসবে সেইটা খুঁজে বের করেন। দায়িত্ব নেয়া কঠিন, তার চেয়ে নারীবাদীদের 'বালেশ্বর' বলে ফেলা, তাদের নারীবাদ হয় কি হয় না সেটা বাটখারা দিয়ে যে মাপা সহজ সেটা আপনাদের দেখে বুঝেছি। সহজ রাস্তায় হাঁটবেন না ভাইলোগ, চলেন সবাই মিলে দুর্গম রাস্তাতেই যাই। আখেরে লাভ হবে।

লেখক: সাংবাদিক