মেয়ে কবে স্বাধীন হবে?
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৯, ২৩:৩৯ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০০:৩৫
সুপার মার্কেটে দেখা হল তার সাথে। আমার এক ক্লাস সিনিয়র বড় আপা। সবসময় ফিটফাট স্নিগ্ধ দেখেছি তাকে। এখন কেমন বিধ্বস্ত, বিমর্ষ। সাথে ছোট্ট বাচ্চাটার হাত ধরে আছেন। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু লোকটির অত্যাচার থেকে এখনো বের হতে পারেননি। এখনও নানাভাবে পীড়ন করে চলেছে তাকে।
সুপার মার্কেটের ভীড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের কথাগুলো পাগলের মত বলতে শুরু করল সে। দুই চোখ দিয়ে জল পড়ছে। আটকাতে পারছে না কোনভাবেই। আমি কোনমতে তাকে শান্ত করলাম। ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম বাসায় গিয়ে ফোন করতে। এরপর গত কয়েকদিন ধরে তার সাথে কথা হচ্ছে আমার। মেয়েটি ভেঙ্গে পড়েনি। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বললেই ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি, নিজের ভেতরে এতদিন কথাগুলো আটকে রেখেছিল সে। সুদীর্ঘ ষোলো বছর ধরে নির্যাতন সহ্য করেছে। এখন তার সব বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু সমাজ পরিপার্শ্ব আত্মীয় বন্ধুদের কথা ভাবছে, তারা কী বলবে তাকে! বিশেষ করে বাবা মা’র কথা। তাদেরকে কোনভাবেই টেনশনে ফেলতে চায় না সে।
এই মেয়েটিকে আমি ভীষণ সুখী বলে জানতাম। সে গৃহবধূ ছিল। ডিভোর্সের পর এখন সে চাকরি খুঁজছে। মোটামুটি একটা কাজ পেয়েছে বটে, কিন্তু তা জীবন চালানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। ফলে প্রাক্তন স্বামীর কাছ থেকে বাচ্চাদের খরচ আদায়ের লড়াই তাকে করতে হচ্ছে মরিয়া হয়ে। সাথে দুশ্চিন্তা- পরের দিনটা কীভাবে চলবে।
আরেকটি মেয়ে। সে আমার বেশ কাছের বন্ধু। সম্প্রতি স্বামীর সাথে চূড়ান্ত মনোমালিন্যের পর জানতে পারলাম, গত বিশ বছরের দাম্পত্য জীবন এইসব অশান্তি করেই কেটেছে, কারণ মেয়েটির স্বামী পুরুষত্বহীন। অবশ্য তিনি এটি স্বীকার করেন না এবং কোন চিকিৎসাও নেন না। তিনি মেয়েটিকে বলেন, ‘তুই চরিত্রহীন, তাই এইসব চাস’।
এই নপুংসক স্বামীর ঔরসেই জন্ম নিয়েছে তাদের সন্তান যার বয়স এখন সতেরো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এতদিন সে কেন এই বিষয়টি কাউকে বলেনি বা কেন এতদিন ধরে এইসব হজম করেছে!
সে উত্তর দিল, স্বামী যে শারীরিকভাবে অক্ষম সেটি সে বিয়ের পর ছয় সাত বছর বুঝতেই পারেনি। এদেশের হাজারটা যৌন অশিক্ষিত মেয়ের মতই তার যৌনতা সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। ফলে স্বামীর অক্ষমতা এবং একই সাথে নানা বিকৃতিকেই সে শারীরিক সম্পর্ক ভেবে কাটিয়ে দিয়েছে।
এখন মেয়েটি ডিভোর্স চায়। কিন্তু স্বামী তাকে নানাভাবে যন্ত্রণা করছে। মেয়েটি গত বিশ বছর কোন কাজ করেনি। অথচ সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ভাল বিষয়ে মাস্টার্স করা। সে কম্পিউটার ব্যবহারও জানে না। ব্যাংকে গিয়ে টাকা পয়সা উঠাতে অভ্যস্ত না। এমনকি তার মোবাইল ফোনের সিমটা পর্যন্ত স্বামীর নামে কেনা।
স্বামীর সাথে গন্ডগোল শুরু হবার পর মেয়ে পড়েছে অকূল দরিয়ায়। দিশাহারা হয়ে সে দেখে তার কোন নিজের টাকা নেই, পায়ের নিচে কোন মাটি নেই। অথচ সে চাইলেই নিজেকে গত বিশ বছরে একটি প্রতিষ্ঠিত জায়গায় অধিষ্ঠিত করে রাখতে পারত। সে তা করেনি। অক্ষম, বিকৃত রুচির স্বামীর সাথে কাটিয়ে দিয়েছে একটি অতৃপ্ত অসুস্থ জীবন, কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি। স্বামীটি তাকে অফুরন্ত টাকার যোগান দিয়েছে। সব কাজ করে দিয়েছে। চূড়ান্ত আরাম আয়েশে রেখেছে। এখন যখনই মেয়েটির সাথে তার সমস্যার শুরু, যখন মেয়েটি প্রতিবাদ করেছে, স্বামী লোকটি তার যাবতীয় খরচ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি বাড়ির গাড়িটিও তাকে ব্যবহার করতে দেয়নি।
এখন এই মেয়েটিও পাগলের মত কাজ খুঁজছে। কিন্ত এখন তাকে কে দেবে চাকরি?
নারী কবে স্বাধীন হবে?
নারী স্বাধীন হবে সেইদিন, যেদিন তার ভেতরে স্বাধীনতার চাহিদা জেগে উঠবে। যেদিন সে নিজেকে পুরুষের অধীনস্ত একটি বেকুব প্রাণি ভাবা ছেড়ে দেবে। যেদিন সে নিজের যোগ্যতাকে বিশ্বাস করতে শিখবে। যেদিন সে বুঝতে শিখবে যে, নারী কোন অবস্থাতেই পুরুষের চেয়ে কম না এবং নারী ও পুরুষের ভেতরে শারীরিক মানসিক কোন ধরণের কম বা বেশি নেই। যা কিছু আছে সবই সামাজিক। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের ভেতরে এই কম বেশির বোধ তৈরি করে দেয়। এই অসুস্থ বোধ আমাদের শেখায়, নারী কম আর পুরুষ বেশি। এটি পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে আদি ও প্রাথমিক ষড়যন্ত্র।
আমার কাছে যে মেয়েরা পরামর্শ কিংবা সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করে, তারা এসে প্রথমেই এক দফা কান্নাকাটি করে। আমি কখনো এইসব কান্নাকাটির সময় গায়ে মাথায় হাত বুলাই না। আমি অপেক্ষা করি এবং তাকে বলি, তার কান্না পর্ব শেষ হলে যেন সে সবিস্তারে ঘটনা খুলে বলে। আমার এই নিষ্ঠুর আচরণে মেয়েদের রাগ বা ক্ষোভ হবার কথা ছিল। হয় না। প্রায় সব মেয়েই দ্রুত চোখ মুছে স্পষ্ট গলায় নিজের কষ্ট আর বঞ্চনার কথা বলতে শুরু করে। আমার কাজটাও হয়ে যায়। মেয়েরা চোখের পানিতে ভাসা বন্ধ করে স্পষ্ট কঠিন হয়ে উঠুক, এটাই আমার চাওয়া। কান্নাকাটি করে পরাধীনতার শিকল ভাঙা যায় না। বিদ্রোহের শুরু করতে হয় নিজেকে তৈরি করার মধ্য দিয়ে। এই তৈরি হবার প্রথম ধাপই হল স্পষ্টবাদী হওয়া, সাহসী হওয়া, মাথা উঁচু করা এবং প্রয়োজনে চূড়ান্ত বেয়াদপ হয়ে ওঠা।
মেয়ে, স্বাধীনতা তোমার জন্মগত অধিকার। কারো কাছে স্বাধীনতা চাইতে নেই। স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হয় নিজেকে। এর জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধে যেতে হয়। আর যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার প্রস্ততি নিয়ে রাখতে হয় সবসময়। এজন্য নিজেকে তৈরি করতে হয় একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে।
জগতের প্রতিটি মেয়ে এবার মানুষ হয়ে উঠুক।
লেখক: লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা
সূত্র: sharminshams.com