ধর্ষণ ও সহবাসের মধ্যবর্তী ফাইন লাইন
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ২৩:০৬
বিয়ে সর্বরোগের মহৌষধ। পরীক্ষায় ডাব্বা মেরেছে, বিয়ে। প্রেম করছে, বিয়ে। কাজ-কর্মে মন নাই, বিয়ে। ঘরের বাইরে থাকতে ভালবাসে, বিয়ে। বাবা-মায়ের কথা শোনে না, বিয়ে। একবার বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলেই জগতের তাবৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
কিন্তু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, বিয়ে! চমকে উঠবেন না যেন। গল্প নয়, সত্যি। তাও বিয়েটা কার সাথে? স্বয়ং ধর্ষকের সাথেই! ‘বাপু, একবার ধর্ষণ করেছ তাতে কি হয়? সারাজীবন ধর্ষণ করে যাও তার বন্দোবস্ত করে দিলাম। এবার নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে যা করার করো’। ওদিকে দেদারছে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’, ‘জোর করে ধর্ষণ’, ‘যুবতী মেয়েকে রেখে মাকে ধর্ষণ’, ‘ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে’র ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। ধর্ষণ কাকে বলে সে বিষয়ে কারো সম্যক ধারণা পর্যন্ত নাই। তারা এসে সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছেন ধর্ষণের বিচার-আচার কি হবে!
কেউ মনে করেন, বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক মানেই ধর্ষণ। কেউ মনে করেন, ধর্ষণ আর কনসেনচুয়াল সেক্সের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কেউ মনে করেন, প্রেমিকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ না হলে পৃথিবীর যে কারো সাথেই শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে না। আবার কেউ মনে করেন, যতই যন্ত্রণা হোক; স্বামীর সাথে সহবাস কখনোই ধর্ষণ হতে পারে না।
নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাগুলো অনেকদিন ধরে ধর্ষণের সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে চেঁচামেচি করলেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। নারী ও শিশু বিটে কাজ করার সুবাদে বেশ কয়েকটি সেমিনারে এই অধমের উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। কোন ঘটনাকে ধর্ষণ বলা যাবে আর কোনটাকে যাবে না, সে বিষয়ে উপসংহারে আসার আগে সবার ওই সেমিনারের ভুক্তভোগী বক্তাদের অভিজ্ঞতা একবার হলেও শুনে আসা উচিত। যৌনতার যে কি বিকৃতি, নোংরামো তা নিজ কানে না শুনলে বিশ্বাস করা দুরূহ। যাই হোক, ধর্ষণের সংজ্ঞা এখনো অনির্ধারিত। দায়সারা সুপারফিশিয়াল যৌনতাজ্ঞান নিয়ে নারীকে উপস্থাপন করে ধর্ষণের বিষয়গুলো নিয়ে কাজকর্ম চালানো হচ্ছে।
নারীর যৌনতা ভীষণরকম রহস্যাবৃত। ১০/১৫ বছর একসাথে থাকার পরেও পুরুষ সঙ্গী নারীর যৌনতা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারেন। আবার ১০/১৫ দিন একসাথে থেকেই নারীকে পুরোপুরি বুঝে নেওয়ার মতো সেনসিটিভ পুরুষও নিশ্চয়ই রয়েছেন। ধর্ষণ আর সহবাসের মধ্যের ফাইন লাইনটা সবার আগে নারীরই টানতে হবে। পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে সুস্থ বোঝাপড়ার মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি করা ছাড়া গতি নাই। তবে সবমিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, দু’টো শরীর-মন তৈরি হয়ে যৌনতায় অংশগ্রহণ করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। আবার শরীর-মন তৈরি থেকে যৌনতায় জড়ানোর পরেও যেকোন মুহূর্তে যেকোন একটা শরীর সাড়া দিতে না পারে। সাড়া না দেওয়ার মুহূর্তের ঠিক পর থেকে অবগত হয়ে অপরপক্ষের প্রত্যেকটি যৌনাচারণই ধর্ষণ বলে বিবেচিত হতে পারে। এমনকি সম্মতির পরেও শরীর যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা না করলে, শারীরিক যন্ত্রণা অনুভূত হলে এবং তখনও পর্যন্ত সহানুভূতির পরিবর্তে অপরপক্ষ জোরাজুরি করলে অবশ্যই তা ধর্ষণের সামিল হবে।
ধর্ষণ আর যৌনতার মাঝামাঝি দেয়ালকে এ ক্ষেত্রে যন্ত্রণা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ নামের খিচুড়ির কোন অস্তিত্ব আর থাকবে না। এর মতো নোংরা বাক্য কোন মানুষ তার সমগ্র জীবনে কখনো শুনে থাকবেন কি না জানি না। বিয়ে করে ফেললেই ধর্ষণ এক মুহূর্তে সুখানুভূতিতে পরিবর্তিত হতে পারে না। এই বাক্যটি ধর্ষণের শিকার প্রতিটি নারীর যন্ত্রণাকে খাটো করে, অসম্মান করে এবং প্রত্যাখান করে। ধর্ষণ আর যৌনতার মাঝামাঝি দেয়ালকে যন্ত্রণা হিসেবে ধরে নিলে ‘ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে’র ঘটনাও ঘটবে না। যে একবার যন্ত্রণা দেয়, যার মনস্তত্বে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ স্বাভাবিক যৌনকর্ম হিসেবেই প্রতিভাত হয়, তার সঙ্গে ভিক্টিমের বিয়ের তো প্রশ্নই আসে না। ধর্ষণ আর যৌনতার মাঝামাঝি দেয়ালকে যন্ত্রণা হিসেবে ধরলে ম্যারিটাল রেপের ঘটনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। ‘স্বামীদেব যাহাই মর্জি তাহাই করিতে পারবেন’ বিষয়ক সুলিখিত দলিলের গালে চপেটাঘাত করে নারী তার শরীর-মনের ওপর স্বীয় অধিকার ও আত্মসম্মান ফেরত পাবেন বলেই ধারণা করি।
সর্বোপরি ‘বিয়ে সর্বরোগের মহৌষধ’ তত্ত্বের ব্যর্থতা উপলব্ধি করে অভিভাবকগণ পান চিবোতে থাকা সফেদ পাঞ্জাবি-লুঙ্গি পরা মোড়ল-সর্দারদের ছুটি দিয়ে সন্তানের শারীরিক-মানসিক প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে বিয়ের যোগাড়যন্ত করবেন বলেই বিশ্বাস করতে চাই। বিয়ে হোক নিজের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনীয়তায়। অন্যের স্বপ্ন পূরণে, সমাজের কলকাকলি থামাতে বা বাবা-মায়ের চাপাচাপিতে নয়। বলাই বাহুল্য, বিয়ে আহামরি কোন ঘৃত-মধু নয় যে না করলে জীবন নষ্ট হয়ে যায়।
লেখক: সাংবাদিক