সমান ধর্মাচরণের দাবী
প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:১০ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ২২:২৫
ছোটবেলা আমরা যে বাড়িতে থাকতাম তার পাশেই একটা কবরখানা ছিল। সেখানে একটা কাঠের বোর্ডে কালো কালিতে বড় বড় হরফে লেখা ছিলো "মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ"। তারও অনেক পরে যখন নিগ্রো আন্দোলন, মার্টিন লুথার কিং'দের পড়ছি তখন জানতে পারলাম আমেরিকায় নাকি অনেক রেস্তোরায় বাইরে একটা বোর্ড ঝুলতো "ব্ল্যাক এন্ড ডগ্স আর নট এল্যাউড"। দুটোতেই কেন জানিনা খুব মিল খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। যাইহোক, শবরীমালাতে যে কারনে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ, সেই একই কারনে হাজী আলী দরগা সহ বিভিন্ন উপাসনালয়, কবরখানাতেও মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। কারন ধর্ম মানেই পিতৃতন্ত্র আর নারীবিদ্বেষ। ধর্ম নারী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না। পুরুষ সেখানে প্রভু, নারী তার আজ্ঞাবহনকারী। সুতরাং এ হেন চুড়ান্ত নারীবিদ্ধেষী ঈশ্বর এবং আল্লার সামনে মেয়েদের মাথা ঝুকানোর কোন প্রয়োজন আমি অন্তত দেখি না। যে ঈশ্বর বাণী দেন -
“যেহেতু শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুযায়ী মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জাতকর্ম সংস্কার পালিত হয় না তাই তাদের অন্তকরণ নির্মল হয় না। স্মৃতিশাস্ত্র ও বেদ প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রের ওপর স্ত্রীজাতির কোনো অধিকার নেই। তাই তারা ধর্মজ্ঞ হতে পারে না। এমনকি কোনো মন্ত্রের ওপরেও স্ত্রীজাতির অধিকার না থাকায় তারা কোনো পাপ করলে মন্ত্রের সাহায্যে তা ক্ষালন করতে পারে না। তাই শাস্ত্রমতে স্ত্রীজাতি মিথ্যা অর্থাৎ অপদার্থ।” (মনুসংহিতা, ৯/১৮ )
“স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন পৃথক যজ্ঞ নেই। স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো ব্রত এবং উপবাস নেই। কেবলমাত্র স্বামীর সেবা করেই স্ত্রীলোক স্বর্গে যেতে পারেন।” (মনুসংহিতা, ৫/১৫৫)
“চণ্ডাল, ঋতুমতী স্ত্রী, ব্রহ্মবধ করেছেন এমন পতিত ব্যক্তি, দশদিন পর্যন্ত নবপ্রসূতা সূতিকা,শব ও শবস্পরশী- এদের স্পর্শ করলে স্নানের মাধ্যমেই শুদ্ধ হওয়া যায়।” (৫/৮৫)
অথবা যে আল্লাহ বিধান দেন -
"তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র, সুতরাং তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যে প্রকারে ইচ্ছা অবতীর্ণ হও।" (সূরা-২: বাক্কারাহ, আয়াত:২২৩)
‘‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে রক্তস্রাব সম্বন্ধে। আপনি বলুনঃ তা অশুচি। কাজেই রক্তস্রাব অবস্থায় তোমরা স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাকবে এবং পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না। সুতরাং যখন তারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হবে তখন তোমরা তাদের কাছে ঠিক সেভাবে গমন করবে যেভাবে আল্লাহ্ তোমাদের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাওবাহকারীদের ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরও ভালবাসেন।’’ (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ্ ২/২২২)
তাহলে তো এইসব আল্লাহ এবং ঈশ্বরদের তো চূড়ান্তভাবে বয়কট করাই উচিত মেয়েদের। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শবরীমালা মন্দিরে নারী ঢুকবে কি না আর কেনই বা ঢুকবে, তাতে সাম্যবাদ কতটুকু প্রতিষ্ঠা হবে, সেইসব আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। এবং তা নিয়ে আপাতত আমার কোন মাথাব্যথাও নাই।
কিন্তু তারপরেও কিছু কথা থাকে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে দাঁড়িয়ে সমান ধর্মাচরণের দাবী অবশ্যই সমান অধিকারের পথে এগোনোর জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভারতবর্ষের সংবিধান, ভারতবর্ষের আইন প্রত্যেকজন নাগরিককে অধিকার দিয়েছে ধর্ম পালনের অথবা ধর্ম না পালনের। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষকে তার ধর্মচারনের অধিকারে বাধা দেওয়া, শুধুমাত্র সে মেয়ে বলে এবং তার ঋতুস্রাব হয় বলে, এটা চূড়ান্ত অসাংবিধানিক, অনৈতিক, অসভ্যতা। যে সহজ স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াকে নোংরা, অপবিত্র আখ্যা দিয়ে একটি মেয়ের ধর্মচারণের অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে, সেটি না ঘটলে এই পৃথিবীতে বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতো! নারী প্রতিমাসে রক্তাক্ত হয় বলেই তো মোদী থেকে যোগী, স্মৃতি থেকে মনু সবাই জন্মাতে পেরেছেন, সভ্যতা ২০১৯ এর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।
কথা আরো আছে। প্রশ্ন আরো আছে। আজকে হিন্দু কট্টরপন্থীরা বলছে সুপ্রীম কোর্টের কোন অধিকার নেই ধর্মীয় রীতিতে নাক গলানোর। তাহলে সেই একই যুক্তি তো ইন্সট্যান্ট তিন তালাকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য! ইন্সট্যান্ট তিন তালাক অবৈধ ঘোষনা যদি মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়ন হয়, শবরীমালাতে পূজা দেওয়ার অধিকার হিন্দু নারীদের ক্ষমতায়ন নয়? কেন্দ্র সরকার মুসলিম মহিলাদের সমঅধিকার নিয়ে একরকম দাবী করছে, অথচ হিন্দু মহিলাদের সমানাধিকারের প্রশ্নে তাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে কেন?
মুসলিম কট্টরপন্থীরা চায় না মুসলিম পার্সোন্যাল ল্ তে কেউ হস্তক্ষেপ করুক, আর হিন্দু কট্টরপন্থীরাও চায় না তাদের ধর্মীয় রীতি নীতিতে কেউ হস্তক্ষেপ করুক। হিন্দু কট্টরপন্থী আর মুসলিম কট্টরপন্থীতে মূলগতভাবে কোন বিভেদ নাই। দুই দল-ই চায় না ধর্মচারনে সাম্য আসুক। ধর্ম সহনীয় হোক। যদি তাদের সিংহাসন টলে যায়। যদি তারা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। নারীকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে যতদিন নিজের অধীনে রাখা যায় ততো তো তাদেরই লাভ।
সবশেষে এটুকুই বলার, ধর্মের যে রীতিনীতিগুলো অগণতান্ত্রিক, সংবিধান বিরোধী, বৈষম্যমূলক, মানবাধিকারের পরিপন্থী বিচারব্যবস্থার উচিত গণতন্ত্রের স্বার্থে সেটা পরিবর্তন করা। কারন, ভারতবর্ষ মনুসংহিতা বা কোরানের নিয়মে চলে না। সংবিধানের নিয়মে চলে। এবং সংবিধান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের কথা বলে। মন্দির মসজিদ যদ্দিন না উঠে যাচ্ছে, তদ্দিন তাতে সবার অধিকার থাকুক। নারীও পুরুষের পাশাপাশি মন্দিরে পূজা দিক, মসজিদে নামাজ পড়ুক, ইমাম হোক, পুরোহিত হোক, যাজক হোক। শবরীমালাতে ধর্মান্ধ নারীও পূজার অধিকার পাক, একটি গণতান্ত্রিক দেশে দাঁড়িয়ে এটাই কাম্য। এটাই শোভন।
পিরিয়ড নিয়ে যে কুসংস্কার ছড়িয়ে আছে সেটাও দূর হোক। শবরীমালা তো দূর, সাধারন হিন্দু ঘরে পিরিয়ডের সময় মেয়েদের ঠাকুরঘরে অব্দি ঢুকতে দেওয়া হয় না। এতটাই অপবিত্র ভাবা হয় যে পিরিয়ড শুরু হয়ে যাওয়া মেয়েদের কুমারী পূজোর জন্যেও নির্বাচন করা হয় না। শবরীমালাতে পূজোর অধিকার হয়তো পিরিয়ড নিয়ে এই অপবিত্রতা, কুসংস্কার, অশূচিতা দূর করতে সহায়ক হবে। এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে এটুকুই আশা রাখি।
লেখক: শিক্ষক