অনন্তকাল কাউকে পায়ের নিচে রাখা যায় না
প্রকাশ | ০৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:৪৪
দেখুন একটা কথা বলি৷ আমাদের সমাজে, আমাদেরই শুধু না, জগত জুড়েই যেমনটি হবার, শতকরা অন্তত সত্তর আশিভাগ ক্ষেত্রেই যেমনটি হবার, তেমন হয় না। যেমন ধরুন, আইডিয়ালি সীমান্ত থাকার দরকার নেই। বা থাকলেও ওই, সেখানে সেনাদের গুলি চালানোর বা একে অন্যের মাথা কেটে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সেসব হয়৷ যুদ্ধ হয়, সীমা অতিক্রম করে বাংকার উড়িয়ে দেওয়া হয়। কাজেই প্রত্যেক দেশ সেনাবাহিনী প্রস্তুত রাখে। এবার, যেহেতু যুদ্ধ করা ভালো কাজ না, হওয়া উচিত না, এই যুক্তিতে কি মেয়েদের যুদ্ধ করতে বাধা দেওয়া উচিত? (ইয়ে, সম্প্রতি সেনাপ্রধান সেরকম বলেছেন বটে, তবে তার জন্য খিস্তিও খেয়েছেন প্রচুর।) না, উচিত নয়। কারণ যুদ্ধ থাকলে সেনাবাহিনীতে নিয়োগে লিঙ্গবৈষম্য রাখা সভ্য সমাজের নিয়ম না।
আরেকটা খুব অন্যরকম উদাহরণ দিই। আমরা অনেক বড় অবধি (ইন ফ্যাক্ট দু'তিন বছর আগেও বারুইপুরে গিয়ে দেখেছি) দেখতাম, মৃতদেহ পলিথিনে মুড়ে রিক্সা ভ্যানে করে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সম্ভবত বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে বা যাদের ময়নাতদন্ত হবে, তাদের ক্ষেত্রেই এরকম করা হতো। বেশ করে মুড়ে বাঁধা থাকতো মৃতের শরীর, তাতে তার অবয়বই যে শুধু বোঝা যেত তা না, বেশিরভাগ সময় তার পা দু'টি বেরিয়ে থাকতো। ধরুন, আপনি নেয়েখেয়ে তৈরি হয়ে অফিস বা স্কুল যাচ্ছেন, যথাসাধ্য জোরে হাঁটছেন যাতে ট্রেন না মিস হয়, এমন সময় জ্যামে আটকে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং পাশে তাকিয়ে দেখলেন পা-খোলা মরদেহ আপনার পাশে শায়িত রিক্সা ভ্যানের ওপরে। আপনি না পারবেন সরে যেতে, কারণ একদিকে সাইকেল, অটো আর মানুষের ভিড়, আর অন্যদিকে এই রিক্সা ভ্যান, আর না পারবেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতে। কোন সভ্য সমাজে এভাবে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি থাকা উচিত না। হেলথ হ্যাজার্ডের সম্ভাবনা ছেড়ে দিলেও, আম জনতার সামনে দিয়ে এভাবে পিছমোড়া করে বাঁধা পলিথিন মোড়া মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া খুবই জঘন্য পদ্ধতি। কিন্তু এটা হতো। এবং যেজন্য বলা, হতো শুধু না, এককালে এ নিয়ে বেশ লেখালিখি হয়েছিল প্রিন্ট মিডিয়ায় সম্পূর্ণ অন্য কারণে। একজন, যিনি এই মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতেন, তিনি মারা যেতে তার পরিবারে রোজগারক্ষম কেউ না থাকায় আর্থিক সংকট দেখা দেয়৷ তাতে তার মেয়ে এই কাজ শুরু করে৷ গ্রামের লোকে অনেক ছিছিক্কার করে, শহরের বাবুরাও ভুরু কোঁচকায়। কিন্তু সে মেয়ের বক্তব্য ছিল, আমার পরিবারের অন্নসংস্থান করা আমার প্রাথমিক কাজ। বাবা এই কাজ করতেন, আমিও করি। লোকে কী বলল তাতে কিছু আসে যায় না। কথা হচ্ছে, এভাবে প্রকাশ্যে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিত কাজ না। কিন্তু তার জন্য এই মেয়েকে কাজ থেকে বঞ্চিত করা উচিত কি? না, উচিত না।
ধর্ম অতি খারাপ জিনিস। কেউই না মানলে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু যদ্দিন তা না হচ্ছে তদ্দিন অন্তত ধর্ম সহনীয় হোক। মেয়ে পুরুষে ভেদ না করুক, কারোকে জন্মপরিচয় নিয়ে তাকে ছোট না করুক, মেয়ের সাথে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মত ব্যবহার না করুক। শবরীমালায় মেয়েকে ঢুকতে দিক আর চার বিয়েও বন্ধ করুক। মন্দিরে মসজিদে ঢোকার দরকার কেন এরকম আবাল যুক্তি দেবেন না প্লিজ। যদ্দিন সবার না মন্দিরে মসজিদে ঢোকা বন্ধ হচ্ছে, ততদিন সবাইকে ঢুকতে দেওয়ার নাম সভ্যতা, হুইচ শুড সুপারসিড ইয়োর রিলিজিয়াস রুলস।
আর শুধু দুটো কথা। এক, মেন্সট্রুয়াল ব্লাডে কিছু ব্যাকটিরিয়া অবশ্যই থাকে, কিন্তু মেন্সট্রুয়েটিং মহিলা, যিনি প্যাড বা কাপ ব্যবহার করছেন, তিনি সেই ব্যাকটিরিয়া ছড়ান না। প্লিজ। তা হলে মেন্সট্রুয়েটিং মহিলা ডাক্তার আপনার সার্জারি করার সময় আপনাকে সুস্থ করার বদলে অসুস্থ করতেন। মেন্সট্রুয়েটিং মা সদ্যজাত সন্তানকে স্তন্যপান করান। তিনি অফিসে ট্রেনে বাসে আপনার পাশে বসলে আপনার অসুখ করে না। কাপ ব্যবহার করা মেন্সট্রুয়েটিং মহিলা সাঁতার কাটেন, জল দূষিত না করে। আপনাকে রেঁধেবেড়ে দেন, খাবার দূষিত না করে। খাবার টেবিলটি অবধি পরিষ্কার না হলে সেই বিশেষ দিনে আপনি তাঁকেই ডেকে টেবিলটি পরিষ্কার করান, নিজে মুছে নেন না। কাজেই প্লিজ ঋতুমতী মহিলা মন্দির নোংরা করবেন, এই ধারণাটা মাথা থেকে সরান। বেশির ভাগ হিন্দু মন্দির যা ভয়ানক নোংরা হয়ে থাকে ফুল বেলপাতায় পচা দুধে, তা বরং অবিলম্বে পরিষ্কার করানো উচিত।
দুই, দেড় লাখ মালায়লী মহিলা যে মানববন্ধন করেছেন শবরীমালায় নিজেদের প্রবেশাধিকারের দাবীতে, তাতে কিছু বোরখা পরিহিত মহিলাকে দেখে কিছু লোকের খুব ফাটছে যা দেখছি। মুসলিম মেয়ে কেন হিন্দু মেয়ের অধিকারের দাবীতে বলবে? বেশ বলবে। বেএএএশ বলবে। মেয়েরা সব ধর্মেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এবং অবশ্যই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটি পক্ষের একটি বড় অংশ। প্রত্যেক মেয়ের স্বাভাবিক অধিকার আছে অন্যের জন্য বলার। হিন্দু মেয়েরা তিন তালাক চার নিকা এবং মসজিদে ও কবরস্থানে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিয়ে বলবে। মুসলিম মেয়েরাও হিন্দুদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে, অনার কিলিং নিয়ে বলবে। নিয়ম ভাঙা, এবং তা নিয়ে কথা বলা সবসময়েই ভালো। তা সে চাড্ডি বা ছাগুদের যতই ফাটুক না কেন। তবে ইয়ে, একটাই কথা, মেয়েদের অধিকার নিয়ে বলার সময় বোরখাটা খুলে এলে আরেকটু বেশি খুশি হতাম। না এলেও তার বলার অধিকার চলে যায় না যদিও।
মেয়েরা বলবে, কোর্টে গিয়ে লড়বে এবং অধিকার ছিনিয়ে নেবে। আপনারা যতই "আমার ধর্মে অরিজিনালে এসব নেই" বা "মোটে তো ছটা মন্দির। ওদের তো ছশো!" বলুন বা জন্মের রক্তকে নোংরা ভাবুন, মেয়েরা বলবেই। এবং করে দেখাবে। অনন্তকাল তো আর কারোকে পায়ের নিচে রাখা যায় না ভাই। সাপ হলেও ফোঁস করে। এ তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ!
যাকগে, ভালো থাকবেন। দুঃখ পেলেও ভালো থাকবেন। কারণ আপনারা যারা দুঃখ পাচ্ছেন, তাদের আর অন্য কোন অপশন নেই। ধন্যবাদ।
লেখক: প্রকৌশলী