সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা ও আমাদের দৈন্যতা

প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০১৮, ২১:৩৮

পাশের দেশ ভারত থেকে সত্তরের দশকের প্রথম বিশ্ব সুন্দরী রিটা ফারিয়া পেশায় ডাক্তার ছিলেন। ডাক্তারিকেই ভালোবেসে শো-বিজে আর সেভাবে থাকেন নি। ঐশ্বরিয়া রাই ছিলেন সারা ভারতে ইন্টার পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী, পড়তেন স্থাপত্যে। লারা দত্ত মিস ইউনিভার্স যেবার হন, সেবার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্ন/উত্তর রাউন্ডে পেয়েছিলেন ফুল 10 on 10! এই রেকর্ড আজতক কেউ ভাঙতে পারে নি। হালের মিস ওয়ার্ল্ড মানসী চিল্লার, তিনিও মেডিকেল গ্রাজুয়েট। আমাদের পাশের দেশ! বেশি দূরের না! জল হাওয়া জলবায়ু, আমাদেরই তো মতো, না?
 
তাহলে ওদের দেশে ব্রেইন এন্ড বিউটির ছড়াছড়ি হলে আমাদের এই অবস্থা কেন? আমাদের যে কোন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা শেষে কেন এমন কাউকে আমাদের 'রিপ্রেজেন্টেশন' করতে বেছে নিতে হয়, যাদের অপমান দেখতে আমাদেরই বেশ আরাম হচ্ছে? আমাদের দৈন্যতা কোথায়? 

প্রথম দৈন্যতা 
আমরা সুন্দরীদের পড়তে দেই না, আর পড়ুয়াদের সুন্দরী হতে দেই না! সুন্দরী হলে তাকে বুঝাই তোমার রূপ হলেই চলবে, আর মেধাবী হলে বুঝাই তোমার জন্য নাচ -গান-সাজগোজ-ললিত কলা হারাম! একটা মানুষ দুইটা ঘটনার প্যাকেজ হতে পারে, সেটা আমাদের মাথায় আসে না! তাই ষোল কোটির দেশে আমাদের কয়টা মডেল পড়াশোনায় ভালো, ক্ল্যাসিকাল নাচে-গায়, এমন সর্বগুণ সম্পন্ন? 

দ্বিতীয় দৈন্যতা
রক্ষণশীলতা! আমাদের 'ভদ্র মেধাবী পরিবার' থেকে কয়টা মডেল/সুন্দরী উঠে আসে সামাজিক ট্যাবু ভেঙে? ভারতের সুস্মিতা সেনের বাবা বড় আর্মি অফিসার, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বাবা ছিল ডাক্তার, নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের মেয়ে অবধি নাটক সিনেমা করে! আমাদের দেশে আছে এমন ট্রেন্ড?

আমাদের বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো এক মেয়ে গতবার মিস বাংলাদেশ খেতাব পেয়েছিল। সেটা নিয়ে কেঁচো খুড়তে দেখা গেলো ডাইনোসর বেড়িয়ে যাচ্ছে নোংরামির! অবশেষে পদক কেড়ে, রাজ্যের নাটক করে সবাই আবারো জিভ রসিয়ে বললাম, নাহ! মিডিয়া মানেই তো বেশ্যাগিরি! তাহলে ঐ ধরনের লোকজনকেই তো দিচ্ছেন দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে বিদেশের বিউটি প্যাজেন্ট এ! দোষ তাদের নাকি আমাদের? 

তৃতীয় দৈন্যতা 
বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতাকে একেবারে নিজের সম্পদ করে ফেলেছে ভেনেজুয়েলা। প্রতি বছর টপ ফাইভ তো থাকেই, সর্বোচ্চ ২২ বার মুকুটও জিতেছে এই সাধারন অর্থনীতির দেশটি। কারন? এক বুড়ো মিয়া! ওসমেল সৌসা!

সে লোকের এক গ্রুমিং স্কুল আছে। যেখানে দলে দলে মেধাবী সুন্দরীরা বছর জুড়ে গ্রুমড আপ হয়। বলা হয়, ঐ স্কুলে যারা সেরা, ওরাই বিশ্ব সেরা হয়। এবং তাইই হচ্ছে!! রূপ দিয়ে যদি রিপ্রেজেন্টেশন করাতে চান, তবে তা প্রতিনিয়ত ঘষে মেজে সাইজ করতে হবে। মধ্য রাতে এক ছাগলা দর্শন ব্যাটা কালো চশমা পড়ে স্টেজে উঠে বিকট বাংলায় নিজেকে 'মিস বাংলাদেশ' আয়োজনের ফ্র‍্যাঞ্চাইজার দাবী করে বসে, আর আপনারাও রাজি হয়ে এই সার্কাস দেখতে বসেন! আর জাত গেলে হায় হায় করেন, ভিডিও শেয়ার করে মজা নেন; অন্যের অপমান দেখার নেশা যে সবচেয়ে বড় নেশা!

কেন গতবারের ন্যাক্কারজনক ব্যর্থ আয়োজনের পরেই এই ব্যাটার কানের নিচে দুইটা দিয়ে ফ্র‍্যাঞ্চাইজার চেঞ্জ করা হল না? সে তার মনগড়া কোর্স প্ল্যান, ইচ্ছামত বিচারক, খেয়াল খুশির আয়োজন করে আপনাদের 'রিপ্রেজেন্টেটিভ' উপহার দিচ্ছেন, আর আপনারাও তালিয়া বাজাচ্ছেন ছিঃ ছিঃ বলে? আর কিছুই করার নেই আমাদের? 

আমার টিভি দেখা হয় না। হয় না মানে একেবারেই শুন্য পার্সেন্ট! কাল কি কুক্ষণে ড্রইং রুমে বসতেই চোখে পড়ে মিস বাংলাদেশ ২০১৮ এর এই আলোচিত আয়োজন। সময় নিয়ে এই সক্কল তামাশা দেখলাম, লজ্জা পেলাম, মেজাজ খারাপ হল, এ দেশটা যে কবে শুধরাবে - এই আফসোস নিয়ে ঘুমাতে এলাম।

আমি কিছু শেয়ার দিচ্ছি না। আমি পড়ার টেবিল ফেলে নাচ শিখি নি, নাটক করি নি। আমি কাউকে ললিতকলা ধারন করলে উৎসাহ দেই নি। আমি খুব রুচিশীল পরিবার গঠন করলেও আমার মেয়েকে গড়ে তুলবো না একদিন একটা সেরা 'মিস বাংলাদেশ' বানাবো এই স্বপ্নে! তাই আমি ট্রল করলে তো আমাকেই অপমান! এর চেয়ে দোয়া করি, দেশ থেকে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাই উঠে যাক। অন্তত নষ্ট বেনিয়াদের দখলে নাই থাকুক আমার নারীর 'সৌন্দর্য'কে 'রিপ্রেজেন্টেশন করার ভার!' 

লেখক: কূটনীতিক