নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০১৮, ২১:০৩
একটি মেয়ে শিশু জন্মের পর প্রথম বৈষম্যের শিকার হয় তার পরিবারে। জন্মের পর তার জন্ম নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা কল্পনা। আহা! মেয়ে সন্তান! যদি দ্বিতীয় সন্তানও মেয়ে হয় তবে তো কথাই নেই। এই যেমন এবারও মেয়ে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আমার নানুর সাতটি মেয়ে সন্তান তাই যদিও প্রথম সন্তান ছিলাম আমি তবুও আমার মাকে পাড়া প্রতিবেশীরা শুনিয়েছিল এর মায়েরই সাত মেয়ে এর তো সবে শুরু। পাড়া প্রতিবেশীদের বেশিরভাগই ছিল মহিলা। অথচ আমার বাবা ছিলেন খুব খুশি।
মা বাবার দুই সন্তানের একটি ছেলে আর একটি মেয়ে হলে তাদের জন্য থাকে ভিন্নতা সব আয়োজনে। কারণ মেয়ে সন্তান তো পরের ঘরে চলে যাবে। আর ছেলে নাকি হাতের লাঠি। ভবিষ্যত জীবনে তাদের ভরসার হাত হয়ে দাঁড়াবে। বাস্তবতা যদিও অন্য ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু এটা বুঝাবে কে? আমাদের দেশের সম্পত্তি বন্টন আইন এই চাওয়াকে ভালভাবেই উস্কে দেয়। আমার পরিচিত এক শিক্ষিত দম্পতিকে দেখেছি ফুটফুটে দুইটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার পরও তারা আবার সন্তান নিচ্ছেন পুত্র সন্তানের আশায়।
মা বাবা খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন ছেলে আর মেয়ের পার্থক্য। মেয়ে শিশুর খাবার মেনুর সাথে ছেলে শিশুর মেনুর বিস্তর তফাৎ থাকে। মাছের মাথা মুরগীর রান সব ছেলে সন্তানের জন্যে থাকে। ভাল নামীদামী স্কুলে ছেলে সন্তান যায়। মেয়েটি হয়ত পাড়ার কোন অখ্যাত স্কুলে যায়। এখানে নিরাপত্তার পাশাপাশি অন্য আরেকটি মনোভাব কাজ করে তা হলো মেয়েটি বিয়ের পর অন্য বাড়ি চলে যাবে। মেয়ে চাকরি করলে তার ইনকামের উপর বাবার বাড়ির অধিকার থাকবে না।
বাস্তবে আমি অনেক পরিবারে উল্টো দেখেছি। ছেলে বা তার স্ত্রী বৃদ্ধ বাবা মা বা শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্ক রাখে না। এই অসহায় পরিবারের পাশে মেয়েটি দাঁড়ায়। যতটুকু পারে সেই এগিয়ে আসে মা বাবার পাশে।
একটি মেয়ে সন্তান জন্মদানের পর চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এরপর যদি চাকুরীজীবী হন তো কথাই নেই। বাচ্চার যে কোন সমস্যা বা অসঙ্গতির পিছনে মাকে দায়ী করা হয়।
বাচ্চার স্বাস্থ্য ভাল নয় বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ওই যে মা চাকরি করে। আবার বাচ্চার স্কুলের রেজাল্ট ভাল নয় একই কথা মা থাকে সারাদিন বাইরে তো এমনি তো হবে। পতি দিব্যি অফিস করে বাসায় এসে পায়ের উপর পা দিয়ে আয়েশ করেন যা একজন কর্মজীবী মায়ের জন্য অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি সংসার সামলান, বাচ্চাকে সামলান পাশাপাশি চাকরি সামলান। অনেক বাবা বাচ্চা রেজাল্ট খারাপ করলে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন তোমার মেয়ে বা তোমার ছেলে এত খারাপ করে কেন? এক্ষেত্রে এসে সন্তান একা মায়ের হয়ে যায়। বাবা তার সন্তানের সব কৃতিত্ব একা নিতে রাজি বা নিয়ে নেয় শুধু খারাপ কিছু হলেই তার দায়ভার মায়ের হয়ে যায়।
কোন মেয়ে স্বামী পরিত্যক্ত হলে মেয়েরাই সবার আগে হামলে পড়ে নানা সমালোচনায় মুখর হয়। যদি এই মেয়েটি হয় গৃহিণী তবে তো কথাই নেই। বাবার বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ভাই আর ভাবির অত্যাচারে সে হয় কোনঠাসা। এক পর্যায়ে মা বাবারও বোঝা হয়ে যায়। যদি স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কোন মেয়ে মা বাবার শরণাপন্ন হয় তাকে প্রতিবাদ করতে না শিখিয়ে বা তার পাশে না দাঁড়িয়ে বলা হয় মানিয়ে নিতে শেখো। আর সে তোমার স্বামী। আর অপরপক্ষে স্বামীকে উল্টো মদদ দিয়ে বলা হয় ভুল করেছে তাকে মাফ করে ঘরে তুলে নাও বাবা। এমন স্বামী এতে হন আরও বেশী অত্যাচারী আর মেয়েটি সারাজীবন ভিকটিম হয়ে জীবন পার করে দেয়।
যদি কেউ দুর্ভাগ্যক্রমে অকাল বৈধব্য বরণ করে তবে তাকে সরাসরি অপয়া বলা হয়। শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে শুনিয়ে বলে আমার ছেলে বা ভাইকে তো তুমি খেয়েছ আর কিছু ধবংস করার আগে কেটে পড়তো বাপু। আর যদি কন্যা সন্তান থাকে তবে ষোলকলা কারন খুব সহজেই তাদের শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় তখন। ভাবুন তো এমন মেয়ে কতটা অসহায়।
আমি বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে দেখেছি বিধবাদের অশুচি ও অপয়া ধরা হয়। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বিধবাদের নাকি হলুদ ছোঁয়ার অধিকার নেই। কারন তার ছোঁয়া হলুদে নবদম্পতির জীবনে দুর্গতি নেমে আসতে পারে বলে কুসংস্কার আছে। একটা মেয়ের উপর এইসব নিয়ম দেখিয়ে আরও দশটা মেয়ে চড়াও হয়। বিধবা মানে রঙহীন। তার জীবনের সব রঙ মুছে গেছে। তার সাজতে মানা। যদি সে হাসিখুশী থাকে বা পরিপাটি থাকে তবে বাইরে মা শাশুড়ি বা পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে শুনতে হবে কানাঘুষা। তাই তো এত রঙ উনার মনে আসে কোথা থেকে? নিশ্চয়ই তার বাইরে অ্যাফেয়ার আছে। আর পুরুষমহল ভাববে আরে একটু সুযোগ নিয়েই দেখি না! কি আর করা হেন তেন বুঝিয়ে ভোগ করা গেলে ক্ষতি কি?
একমাত্র মুক্তি মেয়েরা নিজের পায়ে যখন দাঁড়াতে শিখবে। ছোটবেলা থেকে মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় মেয়েদের সব প্রুস্তুতি বিয়েকেন্দ্রিক। মা বাবা থেকে শুরু করে সবার এক কথা বড় হয়ে বিয়ে করবে তাই সুন্দর হও রূপচর্চা কর নিজেকে পন্যের মত তৈরি কর তবেই না ভাল পাত্র জুটবে! এখনও অনেক শিক্ষিত বাবা মা মনে করে মেয়ের পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে কক্ষনো নয়। মেয়েদের উপযুক্ত সময় নাকি কলেজের পরই কারন সম্মান বা স্নাতকোত্তর শেষ করতে গেলে মেয়ের বয়স নাকি বেড়ে যাবে। আর বয়স্ক মেয়ের বিয়ে দেয়া কঠিন। অনেককেই বলতে শুনেছি পাত্রীর পড়াশোনা শেষ মানে স্নাতকোত্তর শেষ এ মেয়ে তো বেশী বুঝবে তাই বাগে আনা মুশকিল হবে। তার চেয়ে কম বয়সী কলেজ পড়ুয়া ভাল তাকে আয়ত্তে আনা সহজ হবে।
একটা মেয়ে যেদিন বুঝতে পারবে তার জন্য পড়াশোনা এবং সর্বোপরি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। যেদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে পারবে সেদিন বুঝতে পারবে এই সমাজে তার ভুমিকা কতটুকু।
এভাবে যুগে যুগে ছেলে মেয়েকে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হচ্ছে। আমরা মেয়েরা সেই আবর্তেই ঘুরছি। নিজের ভাল মন্দ আমি যদি না বুঝি বা প্রতিবাদী না হই তবে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়েও সংসার জীবনে প্রবেশ করার জন্য তার চাকুরী জীবনের ইস্তফা দিয়ে দেয়। সে তখন দিব্যি শাড়ি, গহনা, পার্লার আর বাচ্চা সামলাতেই জীবনপাত করে। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি আমার দেখা এক দম্পত্তি আছে যারা একটি মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে চাকুরী করতো। বিবাহ করলে একজনকে চাকুরী ছাড়তে হবে তাই বেশী যোগ্য স্টাফ হয়েও মেয়েটি চাকুরী ছেড়ে দেয়। পরে শুনেছি শ্বশুরবাড়ি মূলত স্বামী চান না তাই মেয়েটি এখন কোন স্কুলে চাকুরীর চেষ্টা করছে। অথচ এমন যদি হত দুজনই একসাথে চেষ্টা করে একজন অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যেতো তারপর না হয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতো।
একটা মেয়ে তার সংসারের প্রতি যে মায়া দেখায় বা যে বন্ধন থাকে তা একটি ছেলের থাকে না। যারা পড়াশোনার সুযোগ পায়নি বা মাঝ পথে ছেড়ে দিতে হয়েছে তারা নিজের ভিতরের আমিকে আবিষ্কার করতে শিখবে কবে? এখন বরংচ শিক্ষাহীন, নিরক্ষর মেয়েদের কিছু করার স্পৃহা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা গার্মেন্টসে বা বিভিন্ন বাসায় ঠিকা কাজের লোক হিসেবে কাজ করছে পাশাপাশি সংসার করছে। সেইদিন কবে আসবে যেদিন অন্ততপক্ষে প্রতিটি শিক্ষিত মেয়ে কর্মজীবী হবে নিজের পরিচয়ে বাঁচতে শিখবে! সেইদিন তাদের জীবনে যেমন আসবে সামাজিক মুক্তি তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তি।
লেখক: স্কুলে কর্মরত