পাকিস্তান ঘেন্না
প্রকাশ | ০১ অক্টোবর ২০১৮, ২০:১৭
পাকি, পাইক্কা, ফাকিস্তান বলতে নিষেধ করা মানেই পাকিস্তানকে নিঃশর্ত সম্মান করতে বলা নয়। মানুষ খুন, রক্ত-সাগর ভুলে গেলেও যোনিতে বেয়নেটের নল ঢুকিয়ে ক্ষতবিক্ষত মানচিত্রের কোমরে জন্মদাগ কোনদিন ভুলি নাই। কৈশোরের দিনগুলিতে বইয়ের নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে একাত্তরের গল্প পড়ে বালিশে মুখ চেপে হাউমাউ করে কান্নার দিন কোনদিন ম্লান হয়নি। পাকিস্তান নামটা শুনলেই ছেঁড়াফাটা শাড়ি, লাল রং ব্লাউজ, বেওয়ারিশ চামড়া লেগে থাকা কাঁটাতারে ঘেরা একটা জঘন্য দেশের ছবিই এখনো চোখে ভেসে ওঠে।
পাহাড়ে চলতে থাকা বাঙালি সেটেলারদের নৃশংসতা ব্যথিত করে। মাথা পেতে সেটেলারদের গালির ভগ্নাংশ কানে তুলে নিই চুপচাপ। শুধু ‘বাঙালিরা শুয়োরের বাচ্চা, বেজন্মার জাত’ শুনলে গলার কাছটা শক্ত কাঁটার মতো শিথিল হয়ে আসে। সইতে পারি না। বর্বরতা কোন একক ব্যক্তির ক্রিয়া নয়, কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের জন্য প্রশাসনের মদদ থাকে। আমার বা আমাদের মতো অহিংস মানুষজন এখানে কোণঠাসা, আমাদের ক্ষতবিক্ষত হৃদপিণ্ড এখানে প্রণিধানযোগ্য অপার্থিব সিম্প্যাথি যোগাড় করতে সমর্থ হয় না।
তবু চাই একটা দেশকে বিকৃত নামে না ডেকে, প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে সাধারণ জনগণের কাঁধের ওপর না চাপিয়ে, বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর লজ্জাবনত স্বীকৃতিগুলোকে শ্রদ্ধা জানানো হোক।
একটা দেশকে ঘৃণা করার জন্য গালাগালিই শেষ কথা হতে পারে না। সেই দেশের সালোয়ার কামিজ, পাকিস্তানি লন, বৈদ্যুতিক পাখার পাশাপাশি শিশুখাদ্য, জুস, কাটলেরি, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামেরও বড় বাজার রয়েছে এই স্বাধীন দেশে। পাকিস্তানের বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, দেশটির রফতানি আয়ের শীর্ষ ১০ গন্তব্যের একটি বাংলাদেশ। দেশটি থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় ৬০ ধরনের পণ্য।
তথ্যগুলোয় নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন না বা ইতোমধ্যেই হয়ত জেনেছেন। আরো একটি তথ্য তবে জানিয়ে দিই, বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে ২০০-এর বেশি বৈদ্যুতিক পাখা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। তারপরও এখনো ক্রেতারা পাকিস্তানি ব্র্যান্ডেই বেশি আস্থাশীল। এছাড়া দেশটি থেকে আমদানিকারকরা মসলা আমদানি করেছেন ১১ লাখ ডলার, বৈদ্যুতিক পাখা ৫০ লাখ ডলার ও প্লাস্টিক দ্রব্য প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ ডলারের।
আচ্ছা এই যে আমরা এত ঘেন্না করি, তাতে কি তাদের কিছু এসে যাচ্ছে? যারা দেশভাগের পরেও ২৪টা বছর লুটপাট করে, এই দেশের নারীদের গা থেকে চামড়া তুলে নিয়ে, শিশুদের দু’পা ধরে ফেড়েচিড়ে এমনকি একটা সুতোকেও অক্ষত রাখেনি আমাদের প্রশাসন তাদের সাথে আস্থাশীল কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে এইজন্য আমাদের বিবমিষা জাগার কথা নয়? ঘেন্না আপনি আমি করতে পারি, আমাদের মস্তকের মালিকানা যারা করেন তারা করতে পারেন না? যে দেশ আমাদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করেছে তাদের কাছে আমরা রফতানিতে শীর্ষ দেশ হয়ে উঠছি এতে কোন লজ্জা নেই আমাদের?
আমরা তো আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করলে চলে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেন্টিমেন্ট বেচে, ‘ফাকিস্তানি’ বলে ঘেন্নার চাষবাস করে অনেক বড় হতে পারব কিনা জানি না তবে যাদের প্রতি এত ঘেন্না পুষে রাখছি তারা কিন্তু অর্থনীতিতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে ক্রমশই। নিজেদের গাঁটের পয়সা দিয়ে স্বয়ং আমরাই তাদের সেই শক্তি যোগান দিচ্ছি। মুক্ত বাজার অর্থনীতি। প্রশাসনও কিন্তু জোর করে সাধারণ মানুষকে দিয়ে পাকিস্তানের ব্যবসা জোরদার করতে পারত না যদি আপনিই তাদের পণ্য বর্জন করতেন। ক্রিকেট-ফুটবলে বারবার ৭১'র মতো গভীর একটা সময় টেনে আনতেন না। খেলার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ এনে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতেন না।
এইবেলা বাজারে গিয়ে পাকিস্তানি লন, হোম টেক্সটাইল, মুরগী, প্রসাধনী কিনে এনে বাসায় ওয়াইফাই অন করে ‘ফাকিস্তানি’ বলে গালি দেওয়ার মতো হিপোক্রিসি করে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর আত্মাকে অসম্মান করা বন্ধ করেন। সজ্ঞানে এখনো পর্যন্ত কোন পাকিস্তানি পণ্য আমার চৌকাঠ পেরোয়নি, রাস্তায় একটা চকলেটের খোসা বা বায়ো-ডিসপোজেবল একটা টিস্যুও কোনদিন ফেলিনি, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানকে ঈশ্বর জ্ঞান করে ভালবাসি, কোন অনিয়ম দেখলে নিজের ক্ষতি হবে ভেবেও প্রতিবাদ করি; এটাই আমার দেশপ্রেম। দেশ কি দিচ্ছে ভাবার আগে আমার সাধ্যের ভেতর যা দেওয়া সম্ভব তা দিতে পারছি কিনা সেটা একবার ভেবে নিই। কোন দুর্দিন এলে এই দেশপ্রেমই আমাকে গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড় করাবে।
ঘেন্না যেমন নিভৃতে পুষে রাখতে হয়, চাষ করতে হয় না ঠিক তেমনি দেশপ্রেমও রক্তে বইয়ে রাখতে হয়, খালি ফেইসবুকে চাষ করলেই তরতর করে বেড়ে ওঠে না। এসব অনুভূতি, প্রেমের মতো। শক্ত আর তীব্র, এর ওপর ব্যক্তির কোন হস্তক্ষেপ নেই। দেশপ্রেমকে উগ্র জাতীয়দাবাদের প্রাথমিক স্তম্ভ বলে যারা প্রচার করছেন, তাদের জন্য শুভকামনা। কালের পরিক্রমায় সকলি ফিরে ফিরে আসে, আপনাদের মানসিকতা অপরাপর ঘেন্না সইবার যোগ্য ও শক্তিশালী হোক।
লেখক: সাংবাদিক