পুরুষতন্ত্রের ভোটতন্ত্র : নারীর শরীর আজো ব্যালট বাক্সের ট্রাম্প কার্ড
প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৩৫ | আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৪৬
৩/৪ দিন আগে পরিচিত একজনের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘটনাটা রিমাইন্ড করলাম। তার উপর এক বন্ধু হলজীবনের একটা ছবিতে লাইক দেয়ায় অনেককিছু একসাথে মনে পড়ে গেল। ঘটনাটা ২০০৩/৪ সালের। ছেলেদের হল থেকে হঠাৎ ছড়ানো হলো, রোকেয়া হলের মেয়েদের ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে। গোসলের সময়ের ভিডিও। মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের গোসলের ভিডিও করে তা বাইরে ছাড়ছে। বোঝেন অবস্থা! কয়েকটা মেয়েকে চিহ্নিত করে গল্পটা ছড়ানো হলো। এর মধ্যে একজনকে চিনতাম। একটু কালচার টালচার করতো, কবিতা আবৃত্তি, ফিল্ম সোসাইটি। মেয়েটার সবচেয়ে বড় অপরাধ সম্ভবত এই ছিল যে, সে তার সমবয়সী বন্ধুদের সাথে অতটা মিশতো না। পত্রিকায় কন্ট্রিবিউট করার সুবাদে তার কিছু সিনিয়র বন্ধুবান্ধব হয়েছিল এবং যেহেতু তারা সিনিয়র অর্থনৈতিকভাবেও তারা মেয়েটার চেয়ে সক্ষম ছিল। বন্ধুদের কারো গাড়ি ছিল কারো বাইক। মেয়েটা হয়তো আড্ডা মেরে কোনদিন গাড়ি থেকে কোনদিন বাইক থেকে নামতো হলগেটে। ব্যাস, যেকোন ছাপ্পা লাগানো এই মেয়েটার গায়ে সোজা।
"ভিডিও বের হইছে, ভিডিও বের হইছে" সে কি চাপা উল্লাস চারদিকে! মেয়েটা অত পাত্তাটাত্তা দেয় না। একটা দৈনিকে সাব এডিটরের চাকরি করতো সে। তো অফিসেও সবাই মুখ টিপে হাসাহাসি। “কি তোমাদের রোকেয়া হলের মেয়েদের না কি ভিডিও বের হইছে!” মেয়েটা উড়িয়ে দেয়, আরে নাহ এইসব আপনারা বিশ্বাস করেন! তারপর মেয়েটার এক মেয়ে কলিগ বিরাট আনন্দিত হয়ে এসে বলল, "আরে তোমার নাম তো পত্রিকায় ছাপা হইছে, রুম নাম্বার, ডিপার্টমেন্ট এর নামসহ। তোমারই নাকি ভিডিও বার হইছে?"
মেয়েটা এইবার দিশেহারা হয়। গোলাম মোর্তজা সাহেব তখন হট তরুণ সম্পাদক। তার পত্রিকা সাপ্তাহিক ২০০০ এ মেয়েটার নাম রুমনাম্বারসহ ছাপা হয়েছে। বড় সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা সাহেব তার পত্রিকার রিপোর্টার যে মেয়েটার কোন বক্তব্য ছাড়াই নিউজটা ছেপে দিলেন, তার জন্য কোন অনুতাপ করেন নাই। পরে মেয়েটার দেয়া একটা রিজয়েন্ডার অবশ্য বিকলাঙ্গ করে ছেপেছিলেন।
এদিকে ধুন্ধুমার অবস্থা। রোকেয়া হলে মিছিল ওই তিনচারজন মেয়ের বিরুদ্ধে। যারা তাদের ইজ্জ্বত নিয়ে খেলছে তাদের শাস্তি দিতে হবে। টিভি ক্যামেরা এলো, তদন্ত কমিটি হলো। প্রতিদিন মিছিল মিটিং। রোকেয়া হলের তিন/চারটি মেয়ে, যারা মফস্বল থেকে এসেছে লাল লাল নীল নীল ঢাকা শহরে, তাদের প্রাণ তখন থরথর প্রদীপের শিখা।
আমার চেনা মেয়েটি কিন্তু পরিস্থিতিটা সামহাউ সামলে নিল। ঘটনাটা ডাহা মিথ্যা ছিল, আর সত্যের আলাদা আলো আছে, তাই মেয়েটা সামলাতে পেরেছিল। কয়েকদিন তদন্তকমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল তারপর ঘটনাটায় পলি পড়ে গিয়েছিল, সময়ের পলি।
যে ছেলেরা ঘটনাটা ছড়িয়েছিল তারা হয়তো মেয়েগুলোর বয়সেরই হবে, কতটা বিকৃত অবদমন থাকলে ঠান্ডা মাথায় এধরনের ঘটনা ছড়ানো যায় আমি এবয়সে এসে শুধু তাই ভাবি।তখন থেকেই কি মানুষের বদল শুরু? তারো আগে বাঁধনের ঘটনাটা মনে পড়ে কিন্তু সেটার একটা প্রেক্ষাপট ছিল, সাময়িক উত্তেজনায় পশু হয়ে গিয়েছিল ছেলেরা। কিন্তু এই যে কতগুলো ছেলে মিলে ঠান্ডা মাথায় একটা ঘটনার ছক কাটলো, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা কেউ তাদের দিলো না, তাদের কোন তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হলো না!
আজ ট্রাম্প এর বউ মেলানিয়ার নগ্ন ছবি প্রকাশ হওয়া এবং তা নিয়ে আলোচনা দেখে আমার রোকেয়া হলের ঘটনাটার কথা মনে পড়লো। হায় নারী! তুমি শরীর। শরীর। শরীর। এর বাইরে কিছু নও। সে আমেরিকা হোক কি আদাবর! ৯৫ সালের ছবি। এখন নির্বাচনে কাজে লাগছে। নারীর কাজে লাগার কত ধরণ! যে ছবিগুলো প্রকাশ হয়েছে তার সবই নারীর সাথে। ধারণা করা হচ্ছে এলজিবিডি ভোট টানার জন্যই ছবিগুলো ছাপা হয়েছে। পুঁজিবাদ তার পূতিগন্ধ নিয়ে চিরকালই নারীকে চেপে ধরে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, মনিকা লিউনেস্কির পেন্টিতে ক্লিনটন এর সিমেনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া অসভ্য বর্বর মিডিয়ার কথা? মেলানিয়া স্থাপত্যে স্নাতক, পাঁচটা ভাষা জানেন, অসাধারণ সুন্দরী। এইসব কিছু ফেলে তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে নিজের নগ্ন ছবি নিয়ে।
কিছুই কি কোথাও বদলেছে? বাংলাদেশের সমাজ? আমরা এখন অনেকেই লিখছি। কিন্তু আমি জানি, রোকেয়া হলের সবকিছু নিজের সহজাত ক্ষমতা দিয়ে সামলানো সেই মেয়েটি তার এই ঘটনা বুকটান করে বলতে পারবে না।তার সামাজিক অবস্থানই তাকে বিরত রাখবে। সমাজ এখনও নিতে শেখেনি। সে যদি বলে, লোকে একটু হলেও বাঁকা চোখে তাকাবে, বলবে, "ও সেই ঘটনা! তুমিই সেই ঘটনার নায়িকা!"। আর মেয়েটার একসময় কি জানি নিজের শরীরকে একটু একটু ঘেন্না লাগবে, আমেরিকার ৪৫ বছর বয়সের মেলানিয়াও নিশ্চয়ই কখনও গোপনে কাঁদবে। ইতর মিডিয়া সেই গোপন কান্নার খবর রাখবে না।
লেখক: সাংবাদিক