আমাদেরও মানুষের মতো বাঁচতে ইচ্ছে করে!
প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০১৮, ২৩:৩২
প্রিয় পুরুষ, দেখো, নারীবাদী বলতে তোমরা যা বুঝো, আমি ঠিক তা নই। অমুক অধিকার দাও বলে তোমাদের কাছে আবেদন করতে আমার সম্মানে বাধে। অধিকার যদি তোমার কাছেই চেয়ে নিতে হয়, তবে আর আমি তোমার সমান হই কি করে?
আমার আসলে কেমন হওয়া উচিত, তার একখানা নীতিমালা তোমাদের আছে। সে অনেক পুরোনো আলাপ যদিও। যথা, আমাকে শুদ্ধচরিত্রা, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে পঙ্কিলতা থেকে। আমি কুটিল, লোভী, স্বার্থপর, নির্দয় সব হতে পারি বটে, তবে যদি একবারের বেশি দু'বার প্রেমে পড়ে যাই, তবে সে অপরাধ তোমরা এবং তোমাদের ছাঁচে গড়া আমার স্বজাতি কিছুতেই ক্ষমা করবে না।
একটা সত্যি বলি, তোমরা কি বুঝবে? এই যেমন আমি আশরাফুল মাখলুকাত হলেও একটা সাধারণ প্রাণী বিশেষ। বয়ঃপ্রাপ্ত হলেও মনে নানা রঙ আসে। কি করে বুঝাই সে কোন অপরাধ নয়? প্রকৃতিরই খেয়াল। ভবিষ্যতে পৃথিবীতে নিজের বংশধর তৈরি করার একটি প্রাথমিক ধাপ।
সুতরাং তোমরা যখন কৈশোরে বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে অদ্ভুত রোমাঞ্চ নিয়ে তাকাও, আমরাও তখন রূপকথার গল্পের রাজকুমারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। বর্তমান বাস্তবে রাজকুমার বলে কিছু নেই, তাই তোমাদের মত কাউকেই বসিয়ে দিই কল্পনার পঙ্খীরাজে। না না, এ কথা ভারী গোপন। স্কুলে পড়া মেয়ে রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখবে, এমন বেহায়াপনার কথা আমরা ভাবতেও পারি না।
স্বপ্নের রাজপুত্র কেমন হবে, তা ঠিক আমরা জানি না। রাজপুত্র একটা হলেই হয়। রাজপুত্রের কেমন হওয়া উচিত তা বইপত্রে খুব একটা লেখা নেই। রাজকন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করলেই রাজার দায়িত্ব শেষ। গল্পও শেষ।
আধুনিক কালে রাজপুত্র টুত্র ভারী বিপজ্জনক। তারা ফুল হাতে সামনে এসে দাঁড়ায় বটে, গায়ে হাত-টাতও দিতে চায়, তবে তাদের সাথে সব সময় পরিণয় ঘটে না। যথাসময়ে জানিয়ে দেয়, সে বেকার, পড়া বাকি, বাড়ির বড় ছেলে ইত্যাদি। আমাদের পায়ের তলায়ও মাটি থাকে না, পড়ছি, বাবা মার উপর নির্ভরশীল। তাই অশুদ্ধ, অশুচি মন নিয়ে নিজের মালিকানা বদল করি, বাবা টু স্বামী। নতুন মালিকের কাছে কথাটি গোপন রাখতে হয়, আমি মানুষ হলেও পণ্যের মত আমার ফার্স্টহ্যান্ড, সেকেন্ড হ্যান্ড ভ্যালু আছে। স্বামীজি তার অতীত মনে করে নস্টালজিক হয়, তার পৌরুষত্বের প্রমাণের জন্য প্রেমিকার সংখ্যাও বাড়িয়ে বলতে পারে, আমি বরং গর্বিত হই, বাহ অত মেয়ের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে আমিই শেষ পর্যন্ত...!
কিন্তু যদি বলি আমারো একজন ছিল, স্বামী ব্যস্ত হয়ে উঠবে সর্বনাশ, এঁটো করে যায় নি তো? উদার হলে বলবে, খবরদার কেউ জানে না যেন। লোকে কি বলবে!
তাই জন্ম থেকে আমাদের শুরু হয় শুদ্ধতা বাঁচানোর লড়াই। আমার মা আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে, আমি আমার মেয়েকে বাঁচাবো প্রেমে পড়া যাবে না। ইচ্ছেমত পোশাক পরা যাবে না, কি জানি তাতে যদি কারো লালা ঝরে! আমাকে জানতে হবে তোমাদের সমস্ত প্রতারণার কাহিনী। তোমরা নাকি প্রেমের নামে মেয়েদের প্রেগন্যান্ট করো, এবর্শনও করাও। তোমরা মেয়েদের অশ্লীল ছবি সংগ্রহে রাখো, তোমাদের কথামতো না চললে, বিয়ে না করলে তোমরা বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তোমাদের প্রেমের নিদর্শন পাঠিয়ে দাও। আর বিয়ে করলে মেয়েটিকে ইচ্ছেমত নির্যাতন করতে পারো। কারণ জানই তো, প্রেম করার মত জঘন্য অপরাধে অপরাধী মেয়েটি। তোমাকে বিশ্বাস করে বাড়ি ছেড়েছিল, পড়া হয় নি, কোন কাজও শেখে নি। বাবার বাড়ি যাবার মুখ নেই। বুদ্ধি করে একটা দুটো বাচ্চা ধরিয়ে দিয়েছ। এবার আর যাবে কই। তরকারিতে লবণ কম হলেও চুলের মুঠি ধরতে পার, আস্ফালন করতে পার, বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। তোমার বাড়িই বটে, মেয়েটির বের হয়ে যাবার জায়গা নেই, জানো। তাও বেশ বলে দাও, বের হয়ে যেতে।
তাই মায়েরা আজ মেয়েদের স্কুলে কলেজে আনা নেওয়া করে। রাজপুত্র মনে করে কোন রাক্ষসের হাতে না পড়ে যায় মেয়ে! মেয়ে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ালে অবশ্য তোমাদের মনে লাগে না। কচি মাংস চাই তো। আমরা যখন পঞ্চাশে বুড়ি হয়ে যাই, তুমি তখনো দিব্যি গার্লস স্কুলের বাচ্চা মেয়েটিকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে পার। না, এতে তোমার দোষ নেই, ঈশ্বর বল প্রকৃতি বল সেই তোমাকে এই মহান ক্ষমতা দিয়েছে।
কি ভাবছ, বল তো? কাঁদুনি গাইছি? দয়া চাইছি তোমাদের? আজ্ঞে না। তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি, তোমাদের ওসব বিধ্বংসী ক্ষমতায় আমরা আর ভীত হচ্ছি না। আমাদের মন চাইলে তোমাদের প্রেমে পড়বো, বেচাল দেখলে ছুঁড়ে ফেলে দেবো। মন চাইলে ঘর বাঁধতে পারি তোমার সাথে, ভাল মতো না চললে তুমিই বের হয়ে যাবে। গায়ের জোর দেখিও না আমাদের, মনে রেখো তোমার খাবারটা আমিই রাঁধি। তোমাদের তোয়াজ করে চলতে আমরা বাধ্য নই।
অথচ আমরা তোমাদের সাথে আনন্দে বাঁচতে চেয়েছিলাম। ছোট্ট বাড়ি, দুটি শিশু আর পরিবার পরিজন নিয়ে। বুড়ো হতে চেয়েছিলাম একসাথে। কি করব বল, তোমরা আমাদের মানুষ হিসেবে চাও নি। মেয়েমানুষ হিসেবে চেয়েছো।
কিন্তু, আমাদেরও তো মানুষের মতো বাঁচতে ইচ্ছে করে!
লেখক: চিকিৎসক