একটি মাত্র প্রাণ
প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০১৮, ২৩:১৮
কুরআন শরীফের একটা আয়াত আছে না, "যে একজনের প্রাণ বাঁচালো, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো" (সূরা ৫: আয়াত ৩২)? আমি অনেকদিন পর্যন্ত এর কেবল একটা অর্থই ভেবেছি, - এর প্রতীকী অর্থটাই। কিন্তু সেদিন খুব ভিন্ন একটি উৎস থেকে মনে হলো এর আরেকটি মানেও তো হয়!
ভিন্ন উৎসটি হলো সুস্মিতা সেন, - হু, নায়িকা, বিশ্বসুন্দরী, ইত্যাদি ইত্যাদি, যার সাথে সরাসরি ধার্মিক পবিত্র গ্রন্থের কোন সম্পর্ক নেই। সম্পূরক উৎসটি মাদার তেরেসা, - যিনি ধার্মিক মানুষ ঠিকই, কিন্তু ভিন্ন ধর্মের, - কিন্তু আমি যে বুভুক্ষের মতো সবার কাছ থেকেই জ্ঞান গিলি, - তাই আমার শিখতে কোন বাধা বোধ হয়নি।
সুস্মিতা সেন বলছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে; - তিনি দুই কন্যাসন্তানের দত্তক মা, কিভাবে এই তাগিদটা অনুভব করেছিলেন, সেই সূত্র ধরে বলছিলেন, ১৮ বছর বয়সে বিশ্বসুন্দরীর খেতাব জিতে তাকে বিভিন্ন চ্যারিটি প্রোগ্রামে অংশ নিতে হয়। সেই থেকেই তিনি গিয়েছিলেন তারই শহরের মাদার তেরেসার আশ্রমে। সেখানে দেখলেন আশ্রমে কেবল মাত্র মেয়ে শিশু, - অগণিত তাদের মাঝে কেবল চারটি ছোট ছেলে। তিনি ভাবলেন হতে পারে এখানে মেয়েরাই আছে শুধু, আর পাশের কোন ভবনে ছেলেদের রাখা। কিন্তু না, মাদার তেরেসা বললেন, ছেলে শিশুদের সহজেই দত্তক নেয়া হয়ে যায়, মেয়েরা থেকে যায়। আর এই মেয়েরাই তো বরং ভাগ্যবতী; দুর্ভাগাদের মেরে ফেলা হয় গর্ভেই অথবা, জন্মদানের পরপরই, অথবা, ছুঁড়ে ফেলা হয় এমন কোথাও, যেখান থেকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। এই মেয়েরা তো বেঁচে আছে, জীবনবাজির আরেকটি সুযোগ আছে তাদের।
১৮ বছরের সুস্মিতার মন কেঁদে উঠেছিলো; তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, চারপাশে এতো এতো অন্যায়, এতো সব কষ্ট, - এর মাঝে আপনি মাথা ঠান্ডা রাখেন কি করে? আপনার কি হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না? মাদার তেরেসা হেসে উঠে বলেছিলেন, সব সমস্যার সমাধান তুমি একা করবে কি করে পাগলী? সে তো কেউই পারবে না, - পারে না, - তুমি কেবল একটি প্রাণ বাঁচাবে, আর সেটাই যথেষ্ঠ হবে।
পুরো কথোপকথন আর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সেই নব্য তরুণীর মনে গভীর রেখাপাত করে, আর ২২ বছরে বয়সে তিনি কন্যাসন্তান দত্তক নেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেন। ২ বছর লেগে গিয়েছিলো ভারত সরকারের অনুমোদন পেতে; ২৪ বছর বয়সে তিনি মা হন। তার ঠিক ১০ বছর পরে আবার তিনি যখন কন্যা দত্তক নিতে চাইলেন, আবার বাধা দিলো সরকারি নিয়ম, - ভারতের আইন বলে, দত্তক নিতে হলে পরেরটি হতে হবে ভিন্ন লিঙ্গের। কিন্তু সুস্মিতা তো ছেলে শিশু চাইছেন না, মেয়েই চাইছেন; - সেই যুদ্ধেও জিতলেন, তিনি এখন দুই কন্যার মা।
তিনি প্রথমবার যখন কন্যা ঘরে এনেছিলেন, সেই বছর থেকে ভারতে সন্তান দত্তক নেয়ার হার বেড়েছে ৪০ শতাংশের উপর। তিনি আইনের সাথে যুদ্ধ যেমন করেছিলেন, তেমনই ভেঙে দিয়েছিলেন সংস্কারের শিকল, - অল্পবয়সী অবিবাহিতা গ্ল্যামারাস বলিউড নায়িকা যদি দত্তক নিতে পারেন, সেটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারেন, তখন সমাজের কাছে পুরো বিষয়টি আরেকটু সহজ হয়ে যায়, অহেতুক চক্ষুলজ্জার বেড়ীগুলো একটু হলেও ভাঙে।
তিনি একটি প্রাণ 'বাঁচিয়েছিলেন', আর সেটি আরো কত প্রাণ বাঁচিয়ে গেছে, যাচ্ছে। তার কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার হঠাৎ মনে হলো কুরআন শরীফের সেই কথাটি। যে হয়তো সে বাণী নিছকই প্রতীকী নয়, এটাই হয়তো আল্লাহ সুবহানাতায়ালার আদেশ। যে যেভাবে পারো, একটি করে প্রাণ বাঁচাও। সুযোগ খুঁজো, সুযোগ তৈরী করো। পুরো মানবজাতি রসাতলে যাচ্ছে বলে মাতম তুলো না, তুমি একা একা এমনিতে সবাইকে বাঁচাতেও পারবে না। তুমি পারবে একজনের জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে। সেটি দুয়ার খুলবে পরের সুযোগের, তুমি সেই একটা কাজই করো, তুমি হাল ছেড়ো না, হতাশ হয়ো না।
পৃথিবীতে হতাশ হওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ। হতাশ হওয়ার মতো কি নেই বল তো? হয় উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকতে হয়, নয়তো এই পৃথিবীতে একের পর এক মনভাঙা খবরগুলোর কি অভাব আছে বল? হয় সমাজ বা দেশের অসহ্যকর পরিস্থিতি, নতুবা নিজ জীবনে, নিজ পরিবারে কোন কোন অস্থিতিশীলতা!
সেই মুহূর্তেই আসলে মনে রাখতে হয়, পুরো পৃথিবীটা নয়, তোমার কাজটি ছোট্ট, - একটি মাত্র প্রাণ - একটি মাত্র কাজ - একটি কোথাও তোমার ভূমিকা। সেটি করো, সেটাই নিয়ে আসবে সুন্দর এক আগামী, ইনশাল্লাহ।
"পৃথিবীটা যখন ধ্বংস হয় যাবে কালক্বেয়ামতের দিনে, সেই মুহূর্তেও যদি তোমার হাতে একটি গাছের চারা থাকে, তুমি সেই চারাটি লাগাবে," - এটি নবীজি (সাঃ)'র বাণী। আমার সবচাইতে প্রিয় হাদিস বোধকরি এটাই, - সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে চারা লাগিয়ে কি লাভ? সেটি কি বাঁচবে, আমি কি বাঁচবো, সেই চারা থেকে গাছ হবে কি? আমি কি সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করে পাগল হয়ে যাবো না বরং? নাহ, - তুমি গাছ লাগাও, - এতো উপমা থাকতে তিনি এটাই দিলেন, যে আমার মনে এক রাশ আশাবাদ নিয়ে আসে এই বাণীটি, - যে সুন্দর আগামী আসবেই, তুমি ভেঙে পড়ো না, তুমি কেবল সেই একটি কাজ করো, যেটি তোমার এখতিয়ারে আছে।
"রাজার ওপরে আর করব না নির্ভর –
আমাদের ভাগ্যের আমরাই ঈশ্বর।"
~ অভিযান (সুকান্ত ভট্টাচার্য)
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট