এখন যৌবন যার
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০১৮, ২১:০৪
"এখন যৌবন যার/ যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়"। যৌবন সবারই আসে কিন্তু যুদ্ধে সবাই যায় না। যারা যায় তারাই প্রকৃত মানুষ, তারা স্বপ্নদ্রষ্টা। তারা সাহসী, বিদ্রোহী, পরিবর্তনের দূত, তারা নমস্য।
গত কয়েকদিন ধরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে বাংলাদেশের যুব সমাজের ক্রিয়াকলাপ দেশের মানুষকে চমকে দিয়েছে, নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে।‘এই দেশের কিছু হবে না’ এই দায়সারা বাক্যটি যে অচল, তা তারা প্রমাণ করে দিয়েছে। হবে, এদেশের হবে।
যে দেশে এমন চেতনাদীপ্ত একটা প্রজন্ম গড়ে উঠছে, সে দেশের ভালো কিছু হতেই হবে। আজ না হোক কাল, এদেশে পরিবর্তনের জোয়ার আসবেই। আমরা সেই জোয়ারের আভাস দেখছি, একদিন তার তীরে আছড়ে পড়া দেখব, সেই জোয়ারে সব অসংগতির তলিয়ে যাওয়া দেখবো। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন, কোনো নায়ক নন, কোনো সেলিব্রেটি নন, আমাদেরকে এই স্বপ্ন দেখিয়েছে একদল ইউনিফর্ম পরা ছেলেপুলের দল।
আর এই ইউনিফর্ম পরা ছেলে-মেয়েদের উপর পুলিশি অত্যাচারের কিছু ভিডিও দেখে শিউরে উঠেছি আমি। ফুট ওভারব্রিজের দুদিক থেকে বাচ্চাদেরকে ট্র্যাপ করে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে পুলিশের দল। এর মধ্যে নারী পুলিশও আছেন দেখলাম। মায়ের জাত বলা হয় যে নারীকে সেও এভাবে লাঠিপেটা করতে পারে নিরস্ত্র শিশুদের? তর্ক উঠতে পারে যে এরা পুলিশকে ইট পাটকেল নিয়ে আক্রমণ করেছিল। সেক্ষেত্রে টিয়ার গ্যাস অথবা হোস পাইপ ব্যবহার করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করা যেতো, লাঠি চার্জ কেন করা হলো? একটা দেশে খোলা রাস্তায় পুলিশ বাচ্চাদের উপরে এধরনের নির্যাতন কীভাবে চালাতে পারে? তারপরও সরকার চুপ করে বসে থাকে কীভাবে? দেশের সাধারণ মানুষই বা কীভাবে নিষ্ক্রিয় থাকেন? ইনবক্স থেকে ইনবক্সে ভিডিওগুলো চালান করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নিজেদের কর্মসূচী?
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জনকে হারান নি এমন কেউ কী বাংলাদেশে আছেন? এগারো বছর বয়সে নিজের চোখের সামনে বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হতে দেখেছি আমার প্রিয় বন্ধুকে। আজও সেই ঘটনার বীভৎসতা আমাকে তাড়া করে ফেরে। আমার বাচ্চাদের আপন ফুপা বাস দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, তার মাথা থেঁতলে মগজ বেরিয়ে এসেছিল। এমন দু’চারটা গল্প সবার কাছেই আছে। দীর্ঘদিন ধরে অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন, যিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছিলেন, এক হাতে এই লড়াই লড়ে আসছিলেন। আজ যখন আমাদের সবচেয়ে নাজুক, সবচেয়ে অপরিণত নাগরিকেরা পথে নেমেছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ নিয়ে, পুলিশের কী উচিত ছিল না তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা? তা না করে বাচ্চাগুলোকে বেধড়ক পিটিয়েছে তারা।
সুশীলরা পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে যতটা না সোচ্চার হয়েছেন তার চেয়ে বেশি সরব হয়েছেন বাচ্চাদের স্লোগানের ভাষা নিয়ে। আমি যদি ঐ স্লোগানগুলো লেখার সময় উপস্থিত থাকতাম সম্ভবত আমিও বলতাম, ‘বাবারা এই শব্দগুলো লিখিস না’। কিন্তু যখন একটা শিশু যে ভাষাতেই হোক তার প্রতিবাদ লিখে সেটা মাথার উপরে তুলে সড়কে দাঁড়িয়ে গেছে তখন তার ভাষা নয়, আমি তার আবেগটুকুই দেখবো। ভাষা নিয়ে হৈচৈ তুলে আপনারা আন্দোলনের আদর্শ এবং মূল লক্ষ্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছেন। ভুলে যাবেন না এই শব্দগুলো তারা আপনার আমার কাছ থেকেই শিখেছে। এগুলোর ব্যবহার সর্বত্র, কাজেই ওদের উপর আঙুল তুলবেন না।
সবসময়ই নৈতিকতা এবং সদাচরণের দায় শিশুদের উপরেই চাপিয়ে দেয়া হয়। মা-বাবা কদর্য ভাষায় ঝগড়া করেন, পথে ঘাটে প্রাপ্তবয়স্করা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন, সংসদে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা পরস্পরকে গালিগালাজ করেন, অথচ বাচ্চাদের কাছ থেকে আশা করা হয় নিখাদ ভদ্রতা। সুন্দর, ভদ্রোচিত ভাষা আশা করা দোষের কিছু নয়, কিন্তু আন্দোলন চলাকালে যখন কেউ এইসব শিশুদের কাজ ফেলে তাদের ভাষার দিকে আঙুল নির্দেশ করে, আমার মনে হয় চোখের সামনে আঙুল দিয়ে পাহাড়গুলোকে আড়াল করাই তাদের উদ্দেশ্য।
ভিডিও এবং ছবিতে দেখছিলাম লাইসেন্স না থাকায় দেশের হোমড়া চোমড়া ব্যক্তিদের গাড়ি আটকে দিয়েছে বাচ্চারা। নির্বাচন কমিশনের নামে পতাকা লাগানো গাড়ির কাগজ-পত্র নেই। পুলিশের গাড়ির চালকের লাইসেন্স নেই, ইসলামী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তার ড্রাইভারের লাইসেন্স রিনিউ করা হয়নি- এই সত্যগুলো কি কখনো কোনো ট্রাফিক সপ্তাহেও বেরিয়ে এসেছিল? আসেনি, পরতে পরতে দুর্নীতির আইসিং দেয়া প্রশাসনের কেক খেয়ে আসছে এই দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে। গিলতেও পারছে না, উগড়াতেও পারছে না। দেশের সড়কে সড়কে শিশুদের সারল্য কয়েকদিনের জন্য হলেও সব পাপ ধুয়ে দিল। আমরা দেখলাম সম্ভব, সবই সম্ভব।
অনেকে বলছেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এই আগুনে কেউ কেউ আলু পুড়িয়ে নিচ্ছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাচ্চাদের হাতে এসব অশোভন ভাষার পোস্টার তুলে দিচ্ছে, শিশুদেরকে ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে নিচ্ছে। হতে পারে, বিচিত্র নয়। আবার এ-ও সত্য যে যখন যে আন্দোলনই হয় সেটাকে সরকারপক্ষের লোক বিরোধীদলের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। আমি বলি- আলু পোড়ানোর লোক থাকবেই, তবু আগুন জ্বলুক, পুড়িয়ে দিক চারপাশের দুর্নীতি আর অসংগতিকেও।
সবশেষে বলব ‘নতুন প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয়’ একটা বহুল প্রচলিত বাক্য যা প্রতিটি প্রজন্মেই উচ্চারিত হয়েছে, অথচ দেশের সকল আন্দোলনে সব সময়ই নিজের বুকের রক্ত সবার আগে ঢেলে দিয়েছে নতুন প্রজন্ম। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আবার নতুন করে সেটাই দেখিয়ে দিল।
তোমরা যারা দেশকে ঠিক করতে পথে নেমে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হচ্ছো, সেইসব স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের কাছে একজন মা এবং নাগরিক হিসেবে আমি করজোড়ে ক্ষমা চাই। এই দেশ তোমাদেরকে কিছুই দিতে পারেনি। একটা সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা, নিরাপদ সড়ক, ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা- কিছুই না। তোমাদেরকে খেলার জন্য মাঠ দিতে পারিনি আমরা, ঘুড়ি উড়ানোর আকাশ দিতে পারিনি, গামছা পেতে মাছ ধরার ধানক্ষেত দিতে পারিনি,ডাংগুলি খেলার অবসর দিতে পারিনি। দিয়েছি মা-বাবার সঙ্গহীন দিশেহারা দিন, মুরগীর মত খাঁচায় বন্দী থাকা ডিজিটাল জীবন, পিঠের ওপর বিশাল বইয়ের বোঝা, আর অর্থহীন অজস্র পরীক্ষার অসহনীয় চাপ। বিনিময়ে তোমরা আমাদেরকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছ, নিজের রক্তে লিখে দিয়েছ প্রতিশ্রুতি আর আশার বার্তা। তোমাদেরকে স্যালুট।
লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও নাট্যকর্মী