বাচ্চাগুলোকে বাঁচতে দিন
প্রকাশ | ১৮ জুলাই ২০১৮, ২৩:৫৪ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৮, ০০:১৭
আমি অনেক কথা বলি, সারাক্ষণ কিছু না কিছু বলতে থাকি তার পেছনে কারণ আছে তো। বাচ্চাদের কথা ভেবে, ওদের কষ্টের কথা ভেবে এত কথা বলি। বাচ্চার সামান্য কষ্টও সহ্য করা যায় না।
আমার বড় ছেলেটা ক্লাস নাইনে পড়ে। সাড়ে আটটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত ক্লাস করে তাকে কোচিং এ যেতে হয় তিনটায়। কোনদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে খেয়ে আবার বের হয়ে যেতে হয় ছয়টার ক্লাসে আর ছুটির দিনে সারাদিনই ছুটতে হয় ক্লাসগুলোতে। বাচ্চাকে আস্তে আস্তে স্ট্রেস নেয়া শিখতে হবে- এটা সত্য। কিন্তু সেই স্ট্রেসের মাত্রা কে নির্ধারণ করছে? বয়স অনুযায়ী সেই স্ট্রেসের মাত্রা কিভাবে বুঝি আমরা? বাচ্চার নিজের পড়ার জন্য, লেজার টাইম কাটানোর জন্য, ভাই বোনের সাথে গল্প করার জন্য, টিভি দেখার জন্য সর্বোপরি এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির জন্য বাচ্চার সময় কই?
সামনে ও লেভেল পরীক্ষা, সামনে এসএসসি পরীক্ষা- ব্যাস প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দেও ডলা, দেও পেষা বাচ্চাকে! বাচ্চা সেসব নিতে পারছে কিনা সেটা কোন বিবেচনা না, বাচ্চাকে কলুর বলদের মতো খাটাতে হইবে নইলে সে সিস্টেম এবং তার প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে যে!
শিক্ষা ব্যাবস্থাটা এমন কেন? বাংলা কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম- সব মাধ্যমেরই একই চিত্র। একই চাপ, একই কালচার! স্কুলে পড়ানোর পর কোচিং কেন লাগবে আর কোচিংই যদি লাগবে তো স্কুলের ক্লাস কোন কাজে লাগে? কোচিং আর স্কুলের ভেতর ব্যাবধান এবং তাদের ইন্ডিভিজ্যুয়াল বিশেষত্ব বুঝার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি।
এই নিষ্পেষিত অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে একটা চক্রব্যুহ এর ভেতর পড়ে গেলাম। বাচ্চাদের বাবা মাকে তো থামানো যাবে না। যেখানে যত ছাড়ই দিক কিন্তু বোর্ড পরীক্ষার জন্য কোন উপায় নাই অভিভাবকদের!
সরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনবে না নিজ স্বার্থে। অথচ সরকারের ভূমিকা এখানে ব্যাপক। শিক্ষা ব্যাবস্থাকে শিশুবান্ধব ও বাস্তবভিত্তিক করতে পারে সরকার। সরকার চাইলেই বাচ্চাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। যেকোনো একটা হোক- হয় কোচিং চলুক নইলে স্কুল চলুক। স্কুল থেকে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে হয় বাচ্চাদেরকে, তাই স্কুলটাই চলুক, এই কোচিং থেকে মুক্ত করুক বাচ্চাদেরকে।
কোচিং বন্ধ করার কথা বললে বাবা-মাগুলো আমাকে নির্ঘাত মারবে। আমার এত বড় সাহস আমি বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করার জন্য কোচিং কে 'না' বলছি! কোচিং এ স্যাররা কি দেয়, যা স্কুলের ক্লাসে পাওয়া যায় না? আপনারা একটু বলেন না অনুগ্রহ করে যে কোচিং এ কি পাওয়া যায়? সেই অমৃত স্কুল থেকে নেয়ার ব্যাবস্থা করেন প্লিজ।
খরচের কথাও যদি বলি- স্কুল/কোচিং কোনটাই কিন্তু সুলভ না। কাড়িকাড়ি টাকা দিয়ে আমরা বাচ্চাদের জন্য স্ট্রেস কিনে আনি, তাদের নাওয়া খাওয়ার ঘুমের কোন ঠিকঠিকানা থাকে না, তাদের মাথা ব্যাথা করে, তাদের কিছুই ভালো লাগে না- কাড়িকাড়ি টাকা দিয়ে আমরা বাচ্চাকে এক্সহস্টেড হতে সাহায্য করি!
এসব বলতে না ভালো লাগে না, কষ্ট লাগে, আমার নিজেরই দম বন্ধ হয়ে আসে। আমরা স্কুল কলেজে পড়েছি যখন এমন চাপ, এমন আবদ্ধ ছিলো না কিছুই। বাড়ির কাছে স্কুল কলেজে পড়েছি, মেট্রিক ইন্টারে স্যারের বাসায় ব্যাচে পড়েছি তাও স্কুল কলেজের আশেপাশে। সারাবছর পড়িনি, কয়েকমাস করে পড়েছি, দুইমাস দুটো সাবজেক্ট পড়েছি তো পরের দুই মাস অন্য দুটো সাবজেক্ট পড়েছি, তারপরের দুইমাস আরো দুটো ভিন্ন সাবজেক্ট। সকালে স্কুল কলেজে গিয়েছি, মেইন রোডে তখন জ্যাম থাকতো না, দুপুরে বাসায় ফিরে গোসল করে খেয়ে একটু বিশ্রাম করে স্যারের বাসায় পড়তে গিয়েছি, পড়া শেষ করে বের হয়ে আড্ডাও দিয়েছি, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে নিজের মতো করে পড়েছি, পরিবারের সাথে আড্ডা দিয়েছি, টিভি দেখেছি, খেয়েছি আবার ঘুমিয়েছি, ঘুম শেষে ভোরবেলায় উঠে গিয়েছি।
একটা জিনিস খেয়াল করে দেখুন, আমাদের বাচ্চাদের এখন তেমন আপন কোন বন্ধু নাই, যা আমাদের ছিলো ছোটবেলা থেকে। একসাথে খেলা, একসাথে আড্ডা দেয়া - একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার ছিলো আমাদের, সেই জিনিসটা আমাদের বাচ্চাদের ভেতর নাই। আপনারা বলেন তো- এসব কি আমার ভ্রম নাকি এসবই বাস্তব যা আপনারা লক্ষ্য করেছেন? আমরাও অতিরিক্ত চাপ নিয়েছি ক্লাস টেন, ম্যাট্রিক, ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, ইন্টার কিন্তু প্রাণ ওষ্ঠাগত মনে হয়নি। তখন এত সময় কিভাবে পেতাম আমরা- এখন তা এক বিস্ময়! তখন আনন্দ ছিলো, বন্ধুবান্ধবের ভেতর প্রাণ ছিলো, আমাদেরকে দেখে কারো আবদ্ধ বোধ হতো না কিন্তু এখনকার বাচ্চাদের জীবন দেখে খুব আবদ্ধ লাগে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুল, অনেক দূরে শিক্ষকের বাসা, রাস্তা ভর্তি জ্যাম, অনেক চাপ, সময় নিয়ে টানাটানি, বাচ্চার মনস্তত্ত্ব'র কি দুর্দশা কেউ জানি না কিন্তু। এই বাচ্চারা খেলার মাঠ পায় না একটু, খোলা বিশুদ্ধ হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারে না, বাচ্চাদের ভালো বন্ধুত্বও গড়ে উঠছে না এই অস্থির সময়গুলোতে। এক আবদ্ধ জগতে এই বাচ্চাদের বাস।
বাচ্চাগুলোকে বাঁচতে দিন সুস্থভাবে, ওদের সময়, ওদের জীবনকে আবদ্ধ করে ফেলবেন না। এইরকম আবহে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের থেকে আমি আপনি কিন্তু আর প্রাকৃতিক নান্দনিক মানবিক কিছু আশা করে কিছু না পেলে কোন অভিযোগ/আপত্তি রাখতে পারবো না। এসব বলতে আর ভালো লাগছে না। সত্যিই আর ভালো লাগে না। আপনারা উপায় বলেন না। আপনারা একটা কিছু করেন। সবাই মিলে বাচ্চাদেরকে বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করি, একটা সমাধানে আসি। চেষ্টাটা করবেন কেউ?
লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট