বিবাহিত জীবন ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০১৮, ০১:১১
আমার সুখী বিবাহিত জীবনের গল্প শুনে অনেকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করেন 'তাহলে আগের বিয়েটা টিকলো না কেন? এখন এমন কী করেন যা আগে করতে পারেননি?' গতকাল অপুকে নিয়ে হান্ড্রেড হ্যাপি ডেইজ লেখার পর আমি নতুন করে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি।
আমার সঙ্গীর প্রাক্তন স্ত্রীর অনেক প্রশংসা করি আমি,
'উনি অসম্ভব ভালো একজন মানুষ'।
'উনার সাথে দেখা হয়েছে আপনার?'
'হয়েছে মানে কী, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হয়। একসাথে বসে খাওয়া দাওয়াও করি। হাসিঠাট্টা করি, গালগল্প করি।'
'উনি এতো ভালো তো বিয়েটা টিকলো না কেন?'
নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের ধারণা এমনই। সম্পর্ক টিকতেই হবে, যদি না টেকে তার মানে তাদের একজন মানুষ হিসেবে খুব খারাপ। ভালো মানুষের বিয়ে টেকে না কেমন করে? বিশেষ করে একটা ভালো মেয়ের?
কেউ কেউ ভাবেন, দুজনের মধ্যে যে তালাক দিয়েছে সে খারাপ, বিশেষ করে যদি সে নারী হয়। অন্যরা ভাবেন, যে তালাক পেয়েছে সে-ই বেশী খারাপ, এক্ষেত্রেও বিশেষ করে যদি সে নারী হয়। নারীর জন্য তালাক দেয়া বা পাওয়া দুটোই খারাপ। পুরুষের মন যোগাতে ব্যর্থ নারী, পুরুষের অন্যায় অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের সাথে মানিয়ে চলতে ব্যর্থ নারী কি আবার মানুষ?
আমি এবং আমার সঙ্গীর প্রাক্তন স্ত্রী- আমরা দুজনই মানুষ হিসেবে মন্দ না। অথচ একই পুরুষের সাথে আমাদের মধ্যে একজন ঘর করতে পারেনি, অন্যজন শান্তিতে ঘর করছে। আবার যে এই পুরুষের সাথে শান্তিতে ঘর করছে, সে-ই আগে অন্য এক পুরুষের সাথে ঘর করতে পারেনি। কিছু বোঝা গেল?
আমি বলব দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। অনেক ক্ষেত্রে ভালোমানুষরাই ঘর ভাঙ্গে কারণ তারা নিজের বা অন্যের সাথে অসৎ হতে পারে না, সামাজিকতা অথবা অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবে ভালো থাকার অভিনয় করে যায় না। বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার শক্তি আছে বলেই তারা কোণা ভাঙ্গা কাপটাকে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাদের শক্তি সাহস বা ক্ষমতা নেই, তারাই ঠোঁট কাটার ঝুঁকি নিয়েই কোণা ভাঙ্গা কাপে চা খেয়ে তৃপ্ত থাকার অভিনয় করে যায়।
অনেক ক্ষেত্রে উপায়হীনতার কারণে অসুখী জীবনের বোঝা টেনে যায় অনেক মানুষ। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি এই বোঝা টেনে যাওয়া জীবনকে মহিমান্বিত করার কিছু নেই। হতে পারে নানান কারণে একজন মানুষ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একটা অসুখী সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, কিন্তু যারা পারে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা কি অন্যায় নয়?
আমি এমন অনেক নারীকে দেখেছি যারা স্বামীর হাতে নিয়মিত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েও সম্পর্ক ভাঙতে পারেন না কারণ তাদের উপার্জনক্ষমতা নেই, সন্তানদের নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন নেই, পাশে দাঁড়ানোর মত মানুষ নেই। আবার এমন নারীও দেখেছি যার শিক্ষা, চাকুরী, অর্থ সবই আছে কিন্তু স্বামীর সম্পত্তির লোভ কাটাতে পারছেন না বলে নাটাইয়ের সুতো কাটছেন না। আবার এমন অনেক নারী-পুরুষকেও দেখেছি যারা শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবেই অসুখী সম্পর্ককে অনেক কষ্টে সহ্য করে যাচ্ছেন। এদের কারো প্রতিই আমার অশ্রদ্ধা নেই, বরং সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা আছে।
কিন্তু যারা এই সবগুলো সমস্যা, সম্পত্তির লোভ এবং সাহসের অভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন, যারা সন্তানকে নিজে একা বড় করার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছেন, অথবা যারা বিবাহ-বিচ্ছদের পরও সন্তানকে প্রাক্তন সঙ্গীর সাথে মিলেমিশে বড় করার মানসিকতা রাখেন, তাদের প্রতি আমার সীমাহীন শ্রদ্ধা। মানুষ হিসেবে তারা অনুসরণীয়।
লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও নাট্যকর্মী