আমাদের শাবানা মার্কা শিল্পীরা
প্রকাশ | ০৪ জুলাই ২০১৮, ২০:৫৩ | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৮, ২১:৪৩
"রাষ্ট্র এখন তোমার বেডরুমে পর্যন্ত উঁকি দিতে শুরু করেছে"-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন। রাষ্ট্র আর উঁকিফুকি দেবে কি বেডরুমই তো দেখি রাষ্ট্রের কাছে বিয়ে না ভাঙার আকুল আবেদন জানাচ্ছে!
বেডরুম ফেসবুকে এতো চাউর আজকাল যে ইগ্নোর করতে চাইলেও পারা যায় না। তার উপর আমার বলদামীতে এলার্জি আছে। এইসব বলদদের আমার কিছু বলতেই ইচ্ছা করে। কিন্তু যাদের কথা হচ্ছে তারা হলেন 'শিল্পী'। এদের অভিনয় করা নাটক সিনেমা আমরা দেখি, এদের বানানো নাটক সিনেমা আমরা দেখি।
প্রথমে অপু বিশ্বাস ছেলে কোলে করে টেলিভিশনের লাইভে এসে কেঁদেটেদে সংসার রক্ষা করতে চাইলেন। বাপের ব্যাটা শাকিব খান তারে ইয়েটা দিয়েও গুণলেন না। ছেলে যেহেতু প্রোডাকটিভ খাত তাই তার জন্মদিন টিন পালন হলো, ছেলে কোলে শাকিব খান ছবি টবি তুললেন। আমাদের বিনোদন সাংবাদিকরা গদগদ হয়ে সেসব ছবি ছাপলেন। তারপর শাকিব খান আবার তার যাবতীয় ব্যাটাগিরিতে ফেরত গেলেন। অপু বিশ্বাসরে নিয়ে আমরা এতো লিখলাম, এতো সাহস দেয়ার চেষ্টা করলাম তেমন কোন উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলো না। ইনফ্যাক্ট আমাদের লেখা তার কাছে পৌঁছেছে কি না তাও জানি না। তবে ব্যাটায় ভরা সমাজ তো তার চারপাশে। তাই সেই সমাজ তারে ছেলে কোলে করে শাকিব খানের পিছে পিছে ঘোরার মন্ত্রটা নিশ্চয়ই ঠিকঠাক দিয়েছে। সেদিন একটা পত্রিকায় পড়লাম, সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করছেন, "বুবলির সাথে আপনি কাজ করবেন সুযোগ পেলে?" দুই সতীনের ঝগড়া হলে কেমন হবে সাংবাদিক নিশ্চয়ই সেই রসের দৃশ্য মনে মনে দেখতে উদগ্রীব ছিলেন।
এখন দেখছি শ্রাবন্তী নামে আরেক সাবেক নায়িকা। সে রীতিমতো সংসার বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইছে। আল্লাহরে। তার সংসার বাঁচাতে আরেক নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বিরাট আবেগঘন পোস্ট দিয়েছেন। তার নিজের পার্টনার বিনোদন জগতে কাজ করতে আসা নতুন মেয়েদের বুক হাতায়ে ভিডিওতে ধরা খেয়েছিলেন। আমাদের পতিব্রতা নির্মাতা তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে তারে "অচ অচ"(অরুন চৌধুরী) করে আহ্লাদ করেই যাচ্ছেন। ফলে তিনি আরেক নারীর সংসার 'বাঁচাতে' আকুল আবেদন জানাতেই পারেন।
'আত্মসম্মান' বলে একটা শব্দ আছে সেটা সম্ভবত আমাদের শিল্পীদের ডিকশনারিতে নাই। ডিগনিফায়েড লাইফ তারা লিড করতে শেখেন নাই, অদূর ভবিষ্যতে শিখবেন বলেও মনে হয় না। এর কারন কি আমি অনেক ভাবতে চেষ্টা করেছি। নিজের কাজ বাদ দিয়েও ভাবার চেষ্টা করেছি।
এক. আত্নবিশ্বাসের অভাব
ছোটবেলা থেকেই এদের মাথার ভেতর নরম সরম, সুন্দরী নারীসুলভ ব্যাপারগুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এইসমস্ত শিক্ষা যতটা বিউটিফিকেশন করতে শেখায় ততটা আত্নবিশ্বাসী হতে শেখায় না। সারাক্ষণ চেহারা দেখতে কেমন লাগলো এর বাইরে তারা কিছু ভাবতে পারে না।
দুই. মিডিয়া খারাপ
ফলে এখানে যারা কাজ করে তাদের যখন সংসার হয় তখন তাদের সেটা টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করতে হয়। না হলে লোকে খারাপ বলে। সেজন্যই অধিকাংশ শিল্পী সে মুম্বাই এর হোক কি বাংলাদেশের-বলতে শোনা যায়-বিয়ের পর কাজ করা কমিয়ে দেবো। সংসারই হবে আমার প্রথম প্রায়োরিটি। বেছে বেছে কাজ করবো। বিয়ে করা মানেই একটা পবিত্র জীবনে প্রবেশ করা এর আগে তারা অপবিত্র জীবনে ছিল। এই পবিত্রতা টিকিয়ে রাখা একটা দায়িত্ব। আর পেশাটা ছিল মূলত ভালো একটা পাত্র ধরার ফাঁদ। নট মোর দ্যান দ্যাট। তাই একেকজন নায়িকা কয়েকদিন গ্ল্যামারের ঝলক দেখিয়ে তারপর ব্যবসায়ী পাত্র বিয়ে করে গা ভর্তি অসভ্যর মতো গয়না পরে পেশাকে বিদায় জানায়। কেউ কেউ আবার ব্যবসায়ী স্বামীদের দোহন করে দুধ দুইয়ে কিছু মালকড়ি কামায়ে নেন। পেশায় ফিরেও আসেন। এইজন্য এই পেশাকে অন্যরাও সম্মান করে না।
সর্বোপরি, আমাদের সংস্কৃতি কোন মুক্ত, খোলা হাওয়ার জীবনশিক্ষা দেয় না। সংস্কৃতি এখানে জনরুচির উন্নয়ন ঘটায় না উল্টে জনরুচিতে নেমে এসে এখানকার সংস্কৃতি তৈরি হয়। সেজন্য সমাজে যে 'ভালো মেয়ে' হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে- আমাদের শিল্পীরা সেই প্রতিযোগিতা ভাঙবেন কি, চ্যালেঞ্জ করবেন কি বরং সেই প্রতিযোগিতায় আরও বিপুল বিক্রমে নেমে যান। আমাদের আরেকজন সুবর্না মুস্তফা নেই যিনি বলবেন, আমি কোনকিছু লুকোইনি, যা করেছি মাথা উঁচু করে করেছি। আমাদের মিথিলা আর তাহসান সম্মানজনক সেপারেশনে গেলে, তাদের নিজেদের অত মাথাব্যথা না থাকলেও "প্লিজ আপ্পি-ভাইয়া তোমরা আরেকবার ভাবো" বলে আর্তনাদ ওঠে।
এখন এদের নিয়ে আমাদের কনসার্ন হতে হয় এই কারণে যে এদের থেকে তো শেখে নতুন প্রজন্ম, শেখে সাধারণ দর্শক। তো এরা যদি একেকজন "আল্লাহ তোমার কাছে বিচার দিলাম" টাইপ শাবানা মার্কা হয়, তাহলে এর সমাধান কি?
যে কোন উপায়ে সংসার টেকানো, সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার টেকানো-এইসব স্টেরিওটাইপ ভাবনা ভাঙার মতো শিরদাঁড়াওয়ালা শিল্পী কি কোনদিন আমরা পাবো না?
লেখক: সাংবাদিক