ধর্ম চর্চা বনাম জঙ্গিবাদ (২য় পর্ব)

প্রকাশ | ২৮ জুলাই ২০১৬, ২৩:৪৯

আমাদের প্রথাগত ধর্মচর্চা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত স্বার্থপর করে তোলে এর বহিঃপ্রকাশ সর্বত্র। মাঝে মাঝে আমি খুবই দ্বিধান্বিত থাকি এই যে আমরা যারা ধর্ম চর্চার বুলি আওড়াই বা চর্চা করি তারা কতটুকু ধর্মটাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করি বা আদৌ করি কিনা, নাকি করার ভান করি? ধর্ম যদি সে হয় সত্য ও সুন্দরের পুজারী তাহলে তার অন্তর হওয়া উচিত সব চেয়ে সুন্দর। কিন্তু আদৌ কি তাই? শুধু মুসলিম ধর্মেরই নয় হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যায় ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী সব চেয়ে অত্যাচারী গোষ্ঠী। বর্ণপ্রথা থেকে শুরু করে হিন্দু সমাজের সব নিষ্ঠুরতম প্রথা এরা লালন, পালন করে এসেছে এবং সমাজকে করতে বাধ্য করেছে।

ইসলামের প্রথম যে শর্ত ঈমান অর্থাৎ অন্তরের বিশ্মাস। আমরা সেই বিশ্বাসকে অন্তরের ভিতর স্থান না দিয়ে বাইরে প্রদর্শন করতে সদা ব্যস্ত। নামাজ বা রোজার সময় একটু তাকালেই বোঝা যায় কে কত বড় নামাজী বা রোজাদার তার প্রতিযোগিতা চলে।

বিশেষ করে রোজার মাস সংযমের চেহারাটা, কত রকম ভোগ বিলাস হয় তা একেকটা ইফতার পার্টি বা বাড়িতে ইফতারের আয়োজন দেখলেই বোঝ যায়। এর মাঝে রয়েছে বেরোজদারকে ছোট করার প্রচলন, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন! কিন্তু ভুল করেও কেউ তার বাসার ড্রাইভার, কাজের লোক, গ্রামের দরিদ্র আত্মীয় এদের খাওয়ার খবর নেই না। রোজা শেষে যে ঈদ সেটা তো আরো ভয়াবহ, কার কয়টা ড্রেস কেনা হল সেই হিসেবের সাথে সাথে, মোবাইল সেট, গয়না, আসবাব, আরো কত আয়োজন!

আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়- আমার ফ্লাটের এক বাচ্চা যার বয়স ১০/১২ হবে হয়তো, হঠাত এক রোজার দিনে সিঁড়িতে দেখা, আমাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আন্টি কি রোজা রেখেছেন?” আমার তো আক্কেল গুড়ুম। ওইটুকু বাচ্চার মাথায় এমন প্রশ্ন কিভাবে আসে আর আসলেও কাকে জিজ্ঞেস করা উচিত সেটা সে শেখেনি। এটা অবশ্যই তার পরিবার থেকে পাওয়া শিক্ষা। এই ছেলেটি তো রোজা রাখার কথা জিজ্ঞেস করার বদলে বাড়ির দারোয়ানের ইফতারির খোঁজ নিতে পারতো!
  
আপনারা হয়তো বলবেন এর সাথে জঙ্গিবাদের কি সম্পর্ক?

একটু চিন্তা করলেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন, আমরা যা কিছুই করি তা অন্যকে দেখানোর জন্য। নিজে অন্যের চাইতে শ্রেয় এই বিষয়টা জানান দেবার জন্য। আপনি যদি চুপচাপ নিজের মত করে ধর্ম চর্চা করেন তাহলে তো কোন লাভ নেই, বরঞ্চ অন্যকে জানান দিয়ে করলে আপনার প্রতি অন্যের আগ্রহ বাড়বে। পুঁজিবাদ সমাজের মার্কেটিং আর কি! আমার পরিবার অন্যের চেয়ে ধার্মিক, আমার ছেলে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, এসব আমাদের বাবা-মা দের প্রতি মুহুর্তের আলাপচারিতা। কিন্তু একবারও কি কেউ তার সন্তানের মানবিক গুণাবলি নিয়ে গর্ব করি?

আমাদের ছোট বেলায় ভাই, বোন আত্মীয়-স্বজন নিয়ে জীবন যাপন ছিল, আমাদের ভাগ করে খাওয়া বা পরা ছিল বাধ্যতামূলক। আর এখনকার বাবা-মা তাদের সন্তান নিজের টিফিন যেন একাই লুকিয়ে খায় তার নিশ্চয়তা চায়। ভুল করে কেউ ব্যাতিক্রম করলে মা-বাবা কে সেই সত্যটা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। আর এভাবেই এক একটি সন্তান মানবতার ধর্ম চর্চায় না গিয়ে ধর্মীয় দানবে পরিনত হচ্ছে যার একমাত্র মন্ত্র 'আমিই সেরা, আমি কেবল আমার জন্য, আমার ধর্ম আমার পরকালের চাবির বাইরে কিছু নয়। ইহকাল মায়া মমতায় ঘেরা এক আবেগী জীবন আর পরকাল অর্থ আবেগহীন অনন্ত কষ্টকর অভিশপ্ত অথবা ভোগ, আর অনন্ত সুখী স্বপ্ন। এখানে কেউ কারো নয়, যার যার তার তার। তার মানে ব্যাক্তি কেবল তার একান্ত নিজের। 

লেখক: চলচ্চিত্র পরিচালক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট