বাতায়ন উপাখ্যান: একটি শিশুর জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী
প্রকাশ | ২৩ মে ২০১৮, ০০:৩০
সকালে ঠিক কাজে যাবার আগে আগে এক পশলা দুই পশলা তিন পশলা বৃষ্টি হলো। বুঝে নিয়েছি, আজ তো দেরি হবেই। সময়কে আমরা ধরে রাখতে পারি না, সময় চলে যায়। এই যে বৃষ্টি এলো, থামিয়ে দিল আমার কাজে যাওয়া, সময় থামলো না, সময় কারো জন্য থামে না। আমি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে ব্যার্থ হই। নিজের সাফল্য আর অনুভূতির মাপকাঠি সাজাই, খুলে দেই আমার বাতায়নের দুইটি পাল্লা। আমার মায়াময়, আমার বাতায়ন, যার সামনে বসে আমি সময়ের তোয়াক্কা না করে কাটিয়ে দিতে পারি একটা জীবন। কিন্তু তখন সময় যেন আরো বেশি করে দৌড়ে পালায়।
আমি ঘুমে স্বপ্নে প্রায়ই একটি শিশুকে দেখি। ঝাঁকড়া চুলের মায়াকাড়া চেহারা নিয়ে মেঝেতে বসে সে আঁকিবুঁকি করে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পায়ে ঘুরে বেড়ায় আমাকে ঘিরে। খুব ছোট স্বপ্ন আমার। তারপর কেমন করে সব মিলিয়ে যায় আমি বাস্তবে ফিরে আসি। আমি ভাবি আমার মানস পটের সেই শিশুটিকে নিয়ে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে তাদের বাবা মায়েরা আদরে আহ্লাদে ভিডিও করেন। নিজেদের সন্তানদের নানান মজার কান্ডকীর্তি দেখে নিজেরা মুগ্ধ হন, অন্যদেরও আনন্দ দিতে চান।
স্বপ্নে আমার মানস শিশুটির পিছনে পিছনে আমিও যেন ছুটি একটা ক্যামেরা হাতে। তাকে মানা করি ছাদের প্রিয় হাসনা হেনা গাছ থেকে ফুল ছিঁড়তে, কিংবা ছুটে গিয়ে দেখি লেখার খাতায় ইচ্ছেমতো আঁকিবুঁকি করে ছোট্ট পিকাসো সেজে বীরদর্পে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তার দিকে ক্যামেরা তাক করে বলি, “এগুলো তুমি কি করেছ সোনা?” সে বেশ গম্ভীর এবং সিরিয়াস ভঙ্গিতে উত্তর দেয়, “আমি বাবাকে সাহায্য করি”। আমি তখন বলি, “আর আমাকে সাহায্য করলে না?”, সে আমার লাল নীল রঙে রাঙ্গিয়ে দেয়া খাতার দিকে ইঙ্গিত করে, আমি নিজের খাতা চিনতে পারি না, এবং হায় হায় না করে এক অসীম প্রশ্রয় দিয়ে মনে মনে বলি, তোমার জন্য হ্যাঁ।
আমি যখন আমার মানস শিশুকে স্বপ্নে দেখি, অর্থাৎ আমি যখন এতটা নিরাপদ যে আমি ঘুমুতে পারি এবং ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি। ঠিক তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মানুষ মরে যাচ্ছে ঘুমের ভেতরে, চাপা পড়ে আছে তাদের স্বপ্ন, বোমার আঘাতে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হওয়া তাদের ভালোবাসার বাড়ির দেয়ালের নিচে। পিতা-মাতা নিরুপায় হয় সন্তানের লাশ ধরে বসে আছে। পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত তো অনেক দূর, আমি জানি তখন ওই মূহুর্তে পাহাড়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে হয়ত কোন না কোন শিশু। কিংবা সন্তানের মৃত দেহের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অসহায় পিতা। আমার মনে পড়ে নিহত ত্বকীর কথা, কিংবা রাজন, কিংবা রাকীব, কিংবা শিশু তানহা, কিংবা দিনাজপুরের শিশু পূজা, আমার আরো মনে পড়ে এই দেশেই না খেতে পেয়েও অভিমানে আত্মহত্যা করেছিল কণিকা, আমার মনে পড়ে হয়ত পেটের দায়ে এই শিশুরা যখন বড় হয়, তারা কেউ যৌন কর্মে নামতে বাধ্য হয়, কেউ চুরি ছিনতাই সহ জড়িয়ে পড়ে নানান অপরাধমূলক কাজে। আমার চিন্তা হয়, এই দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা আর কিছু করতে জানুক না জানুক, দিনের পর দিন এই সংকটকালীন সময়ে পৃথিবীতে জন্ম দিয়েই যাচ্ছে শিশুদের, যাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কালো আঁধারে ঘেরা।
আমার মনে পড়ে আইন ও সালিস কেন্দ্র গত দুই বছরের একটা হিসেব দিয়েছে। গত দুই বছরে ২০৪০ জন শিশুর ওপর সহিংসতা হয়েছে, খুন হয়েছে ১০৪২ জন শিশু। যাদের মধ্যে ৪৬৩ জন সাত থেকে বারো বছরের এবং, ২২৪ জন শিশু ছয় বছরের নিচে। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অপহরণ, গৃহকর্মী হিসেবে নির্যাতন, এবং নানান সহিংসতায় প্রাণ গেছে শিশুদের। তাদের হত্যার বা তাদের উপর হওয়া সহিংসতার জন্য দুই বছরে মামলা দায়ের হয়েছে মাত্র ৪৪৭ টি।
আমার মানস শিশুর জন্য কষ্ট হয়, এবং একই সাথে আমি খুশি হই এই ভেবে যে, বাস্তবে আমার সেই ফুটফুটে সন্তানটির কোন অস্তিত্ব নেই, এবং ভয় নেই তার কোন ক্ষতি হওয়ার। সে হয়তো কখনো বড়ই হবে না। কিংবা বড় হবে, বড় হবে অনেক নিরাপদভাবে। আমাদের শৈশবের যৌন নিপীড়নের কোন ঘটনা তার জীবনে ঘটবে না। সে বড় হবে নির্ভীক হয়ে, শারীরিক কিংবা মানসিক আঘাতের ভয়ে সে ভীত থাকবে না। সে শিখবে জীবনে বাঁচতে হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা ভালোবাসা।
আমার মায়াময়, আমার বাতায়ন, আমি জানি না সেই শিশুটিকে, হতে পারে শিশুটি আসলে আমার মানস পটে আঁকা আমারই শিশুমনের প্রতিচ্ছবি। আমি আসলে স্বপ্নে আমাকেই দেখি । কিংবা হতে পারে সেই শিশুটি আদতে প্রতিনিধিত্ব করে পৃথিবীর সকল শিশুদের যারা পৃথিবীতে বাঁচতে এসেছিল, হাসতে এসেছিল, জীবন যাপন করতে এসেছিল। হতে পারে শিশুটি আদতে সেই সকল গুরু গম্ভীর মনের ভেতরের একটা কোণে বন্দী হয়ে থাকা স্বাধীনতা, যে বেড়িয়ে আসতে চায় সকল বন্দিশ থেকে, মুক্ত হতে চায়, হাসতে চায়, খেলতে চায়, বাঁচতে চায়। এই পৃথিবীতে সুন্দর এক সৃষ্টি হিসেবে শিশুটি চায় তাকে সবাই স্বাগতম জানাক, তাকে বলুক হ্যাঁ।
লেখক: আইনজীবী