তারুণ্যের পালে রুগ্ন হাওয়া
প্রকাশ | ২০ মে ২০১৮, ১৫:২৭
ঢাকার স্বনামধন্য একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীদের ধারণা দেয়া হয়েছে 'Body space' সম্পর্কে। একটি মেয়ের কতটুকু কাছে আসলে সে অনিরাপদ কিংবা নিপীড়িত হতে পারে এবং কিভাবে সে সতর্ক হতে পারবে এই সম্পর্কে তাদের সচেতন করার এই উদ্যোগে আমি চমকে উঠেছি। এই কোমলমতি শিশুদের মনে কি প্রভাব পড়েছে আমি জানি না, তবে আমি খুব অবাক হচ্ছি না। ইদানিং এমন একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে জন্মদাতা বাবা গ্রেফতার হচ্ছেন নিজের কন্যাকে নিগ্রহ করার অপরাধে! চকোলেট, বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে দুধের শিশুকে পর্যন্ত ধর্ষণ করা হচ্ছে। সেদিন দেখলাম একজন ছাত্রীকে ক্লাস সেভেন থেকে ভয় দেখিয়ে ক্রমাগত ধর্ষণ করে যাচ্ছে মাদারীপুর শিবচরের উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবিউল ইসলাম। হয়তো মেয়েটি আর সহ্য করতে পারছিলো না, তাই দশম শ্রেণীতে এসে অভিযোগ জানিয়েছে। পরিমলের নব্য সংস্করণ এই লম্পট এখন পলাতক, আর কতো মেয়ে যে এই অসহনীয় যন্ত্রনা ভোগ করছে, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
একদল কিশোরী মিলে গড়ে তুলেছে 'Team Blue Crocodile', এই দলে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে তারা নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়াবে, কেউ বিরক্ত করলে ধরে পিটিয়ে শিক্ষা দেবে। আজকালকার স্কুলের প্রশাসন কিংবা শিক্ষকবৃন্দ অনেক সচেতন। তারা এই দলকে পাকড়াও করে এবং তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে নির্জন একটি কক্ষে কিছুক্ষণ একা থাকতে বাধ্য করে শাস্তি স্বরূপ। শাস্তি হিসেবে এই নির্জন কক্ষে অবস্থান করতে বাধ্য করা নিয়ে আমি মোটেই সন্তুষ্ট নই, সেই সাথে তাদের একটি উদ্যোগ এভাবে ভেস্তে যাওয়ায় আমি হতাশ। এই কিশোরী দলের একজন সক্রিয় সদস্যকে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে জানি, তার এবং সেই স্কুলের নাম প্রকাশ করাটা সমীচীন মনে করছি না। অথচ বেগম রোকেয়া সেই কবেই লিখে গেছেন 'Sultana's dream'।
মেয়েদের বিরক্ত করা নতুন নয়, তবে ধরন পাল্টে গেছে। বিশেষ করে প্রযুক্তির আবির্ভাবে এবং মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাপকভাবে। একটা সময় ছিলো আমাদের সমাজ ছিল মোটামোটি রক্ষণশীল আর যোগাযোগ করাটা ছিল বেশ কঠিন। বন্ধু কিংবা আত্মীয় পরিজনদের মাধ্যমে মনের মানুষের কাছে একটা চিঠি পাঠানো ছিলো রীতিমতো যুদ্ধ। Facebook, Instagram, Viber, Twitter ছাড়াও অগণিত মাধ্যম এখন উন্মুক্ত। সেই সাথে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক হয়েছে শিথিল। যৌথ পরিবার এখন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ব্যস্ত পেশাগত নগর জীবন আমাদের বাধ্য করেছে একক পরিবার গঠন করতে। এতে সবচেয়ে ক্ষতি যেটা হচ্ছে সেটা হলো পারিবারিক শিষ্ঠাচারের চরম অনুপস্থিতি। বয়ঃসন্ধি থেকে শুরু করে এমন অনেক বিষয় আছে, যা আমরা একসময় পরিবারের বয়োজ্যাষ্ঠদের কাছ থেকেই শিখেছি। আজকের প্রজন্ম বঞ্চিত হচ্ছে পারিবারিক সংস্পর্শ থেকে।
গত সপ্তাহের এক রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো, সাথে বজ্রপাতের গগন বিদারী শব্দ। ভালো ঘুম হয়নি, সকালে অফিসে যাবার সময় খেয়াল করলাম পাশের বাসার সদর দরোজার সামনে স্প্রে রং করে লেখা “I Love you ….”, সঙ্গত কারনেই নামটা উল্লেখ করলাম না। এক সময় গোটা দেশেই এই চিত্র দেখা যেতো, ঢাকায় এটা অনেক দিন পর আবারো দেখালাম। ছোটবেলায় দেখতাম অমুক + তমুক, গোটা পাড়া মহল্লায় লিখে জানান দেয়া হতো। তবে দিন বদলে গেছে, এখন এভাবে প্রেম হয় না।
মাস ছয়েক আগে, এমনই এক সকালে অফিসে যাওয়ার সময় একটা ঘটনা চোখে পড়লো। অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তা কর্মী একজন ভদ্র মহিলাকে অভিযোগ জানাচ্ছিলেন যে, তার ছেলে গতকাল রাতে দেয়ালে স্প্রে রং ছিটিয়ে কিছু একটা লিখেছে। ভদ্রমহিলা কিছুতেই তা মানতে চাইছেন না, উল্টো, তার চাকুরি চলে যাবে বলে শাসিয়ে যাচ্ছেন। আশেপাশে লোক জমে যাবার মতো অবস্থা, অথচ তখনো পাশের দেয়ালে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন শোভা পাচ্ছিলো। আমার এখনো মনে আছে, বাসায় অভিযোগ এলে আম্মা সবার আগে আমাকেই ধরে মারতেন, কারন জানতে চাইতেন না। তার সোজা কথা, তুমি কিছুই করোনি ভালো কথা, কিন্তু অভিযোগ যেহেতু এসেছে, তুমি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করেছো।
ছোটবেলায় স্কুলে যাবার জন্য পাগল ছিলাম আমি, ঝড়, বৃষ্টি কিংবা প্রচন্ড খরতাপ, স্কুলে যেতে হবেই। স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে মাঠে গিয়ে কুচকাওয়াজ করবো, সে কি উৎসব। সাইক্লোন কিংবা বন্যায়, বাসা বাড়ি, অলিগলি হেঁটে পুরনো কাপড় যোগাড় করতাম বিপুল উৎসাহ নিয়ে। শুকনো চিড়া, গুড় খেয়ে দুর্গত অঞ্চলে গিয়েছি। স্কাউটিং, বিএনসিসি, যুব রেড ক্রিসেন্ট করেছি সমান তালে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আমাদের খুলে দিয়েছে ভাবনার দুয়ার। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলেছি দল বেঁধে। স্কুল শুরু হবার আধা ঘণ্টা আগে গিয়ে মাঠে খেলতাম, ভেজা ঘাম শুকিয়েছি অ্যাসেম্বলিতে। জাতীয় সঙ্গীতের সাথে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ সাথে শপথ গ্রহন ছিলো নিত্য দিনের রুটিন। টিফিনের ফাঁকে আবারো খেলাধুলা মেতে উঠেছি। দুঃখ হয় এই প্রজন্মের জন্য, তাদের সিংহভাগ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম শিশুদের দুরন্ত নয়, করে তুলছে অলস।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ, যাদের সিংহভাগই তরুণ। শতকরা ৯১% কিশোর ও তরুণ, ৬৫% আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এবং ১৫% উচ্চ শিক্ষিত।
২০১৬ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকায় স্কুলগামী শিশুদের প্রায় ৭৭% নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে। বর্তমানে চারটি পদ্ধতিতে পর্নোগ্রাফি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি পর্নোগ্রাফির তুলনায় ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে তৈরি পর্নোগ্রাফি শিশুরা বেশি দেখছে। আর এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায়, ২৬ অক্টোবর ২০১৬ সালে। তারা আরো লিখেছে, ২০১৩ সালে ঢাকার কয়েকটি স্কুলে জরিপ চালায় একটি বেসরকারি টেলিভিশন। তাতে দেখা যায়, স্কুল শিক্ষার্থীদের ৮২% স্বীকার করেছে যে তারা সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ন ছবি দেখে। সময়ের প্রয়োজনে, সন্তানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে বাবা মায়েরা বাধ্য হচ্ছেন সন্তানের হাতে Communication devices তুলে দিতে, কিন্তু আমাদের একটু ভেবে দেখতে হবে, এই devices গুলো নিরাপদ কি না? এর ক্ষতিকারক প্রভাব কিন্তু ইতিমধ্যে সমাজে দৃশ্যমান হচ্ছে।
আমরা হচ্ছি সাদাকালো টিভি দেখার যুগের মানুষ, এখন আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রবেশ করেছে। আমরা কতজন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানি? শুধুমাত্র Google এ ঢুকলে যে কোন শব্দ, যে কোন ভাষায় লিখে সার্চ করলেই চলে আসবে শতশত সাইটের লিঙ্ক! শিশুবান্ধব ইউটিউব ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। সময় এসেছে, এখন আমাদের অভিভাবকদের জানতে হবে প্রযুক্তি, তা না হলে সন্তানেরা কি ভাবছে কিংবা কি দেখছে তা বুঝতেই পারবো না। এমনিতেই Generation gap বলে একটা শব্দ আছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের এই দূরত্ব চলে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। এই দেয়াল ভাঙতে হবে আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের স্বার্থে।
ইদানিং টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, মা দরজা খুলে মেয়ের কাছে বিনীত ভাবে জানতে চাইছেন, কিছু বানিয়ে (রান্না করে) দেবেন কিনা? মেয়ে মোবাইলে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো, একটু বিরক্ত হয়েই জানালো, পুরো গ্যাং (সব বন্ধুদের একত্রে বোঝাতে) আসবে, আমি রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে নেবো। তুমি বাদ দাও না প্লিজ… বলে মায়ের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো! বাচ্চাদের অনেক কিছুই আমরা নির্দোষ ভেবে এড়িয়ে যাই, ভালোবাসি তাই। সেই মা পরবর্তীতে নুডুলসের বাটি নিয়ে হাজির, মেয়েও আরাম করে খাচ্ছে। কিন্তু মুখের উপর দরজা বন্ধ করার একটা সংস্কৃতি ইদানিং দেখা যাচ্ছে। এটাও ঠিক Privacy বলেও একটা কথা আছে। সময় হলে বাচ্চাদের একটু নিজের মতো করে থাকার অধিকার নিশ্চয়ই আছে, তবে সেটা ভালোমন্দ বোঝার মতো সময় হলে পরে, তার আগে নয়।
আমরা বাবা মায়েদের বেশি করে সময় কাটাতে হবে ছেলে মেয়েদের সাথে। পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তাদের সাথে মন খুলে কথা বলতে হবে। তাদেরও কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। আমরা বলবো, আবার সেই সাথে শুনবোও তাদের কথা। তা না হলে আমাদের সন্তান বিপথে গেলে কাঁদতে হবে আমাদেরই।
তারুণ্য হোক নিরাপদ।
লেখক: উন্নয়নকর্মী