ঘাম দিয়ে, রক্ত দিয়ে আদায় করা 'মে দিবস'
প্রকাশ | ০১ মে ২০১৮, ১৮:৩৯
ভাবতে অবাক লাগে আমাদের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা 'মে দিবস' এর ইতিহাস জানে না। সেদিন আমার এক বন্ধুকে বললাম, "মে দিবসের মিছিলে চল"। আমার সেই সরকারী চাকুরে বন্ধু প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো, "দুর! ওটা তো কমিউনিস্টদের লাল ঝান্ডা নিয়ে পথে হাঁটার দিন"! আমার আরো অবাক হওয়ার পালা!
এই লেখাটা সেই দায়বদ্ধতা থেকে লেখা, যারা মে দিবসের ইতিহাস জানেন না তাদের জন্য এবং যেসব গেরুয়া ফেট্টিধারী ভক্তরা মে দিবসকে বিদেশ থেকে আমদানী করা শ্রমিক দিবস হিসেবে প্রজেক্ট করতে চাইছে, সেইসব কুশিক্ষিতদের জন্যেও।
শুরু করি শ্রমিক নেতা তথা সাহিত্যিক সোমেন চন্দের 'বনস্পতি' গল্পের দুটো লাইন দিয়ে -
"সমাজের যারা পরগাছা- যারা আমাদের গায়ের রক্ত শুষে শুধু বসে বসে খায়, তাদের উপড়ে ফেলবার দিন এসেছে আজ"।
'শ্রমিক' - সভ্যতার প্রতিটি ইট, বালু, পাথরে যাদের ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জড়িয়ে আছে, সেই বুড়ো শ্রমিক, জোয়ান শ্রমিক, মাঝারি শ্রমিক, শিশু শ্রমিক, নারী শ্রমিক, পুরুষ শ্রমিক- সে যে শ্রমিকই হোক না কেন, তারা কিন্তু কখনোই সভ্যতার আশীর্বাদধন্য শ্রেণী ছিলেন না। আজও নয়। আজও তারা শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত। আপনারা হয়তো শ্রমিক বলতে বুঝেন ঠিকাদার মজদুর, অথবা রাস্তাঘাটে, মাঠে বন্দরে কাজ করা কালো কালো শরীরের মানুষ! কিন্তু আপনি জানুন, আপনি, আমি, আমরা সবাই-ই কিন্তু শ্রমিক। হয়তো শারীরিক পরিশ্রম করছি না আমরা, কিন্তু আমাদের মেধা খাটিয়ে মুনাফা লুটছে দেশের একশ্রেণীর মানুষ। আপনি হয়তো প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করেন, অথবা সরকারী; আপনার মাথা আর যোগ্যতা খাটানো পরিশ্রমের মূল্য যৎসামান্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করছে তারা। তাই আপনি যতই বলুন, ভাবুন 'শ্রমিক দিবস' আপনার জন্যে নয়, অথবা মে দিবস নিছকই এক ছুটির দিন, আপনার এখনো অনেক কিছু জানার এবং বুঝার বাকী। আপনার জানার বাকী- আজ থেকে দু শতক আগেও আপনাদের শ্রমের কোনো মূল্য ছিলো না। আপনার জানার বাকী- এই দু শতক আগেই আপনার কাজ করার নিদির্ষ্ট কোনো সময় বাঁধা ছিলো না। আপনারা ছিলেন মালিক শ্রেণীর ক্রীতদাস। দৈনিক দশ থেকে বারো ঘন্টা খাটিয়ে মজুরী মিলতো নামে মাত্র। আপনাদের কোনো ছুটি ছিলো না, আনন্দ, বিনোদন করারও অধিকার ছিলো না। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে যে যে অধিকারগুলোর প্রয়োজন, তার কোনোটাই ছিলো না।
আজকে যে আপনি আট ঘন্টা দৈনিক কাজের অধিকার অর্জন করেছেন, শ্রম অনুযায়ী বেতন চাইতে পারছেন, ওভারটাইম কাজের এক্সট্রা পারিশ্রমিক চাইতে পারছেন, সেটা একদিনে অর্জন হয়নি। শ্রমিকদের রক্তে লেখা ইতিহাসে স্থাপিত হয়েছে আপনার মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার ভিত। যুগ যুগ ধরে সারা পৃথিবীর শ্রমিকরা মুখে রক্ত তুলে, পুঁজিবাদী সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই করে করে, আপনাকে, আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। এখনো অনেক পথ যাওয়া বাকী।
যে পুঁজিবাদী দালালদের তালে তাল মিলিয়ে আপনি 'শ্রমিক দিবস' নিয়ে সস্তা কৌতুক করছেন অথবা অবহেলা করছেন, সেই পুঁজিবাদের দালালদের দ্বারা আপনি আজও শোষিত, নিষ্পেষিত। আপনার শ্রমের ন্যায্য দাম চাইতে গেলে আপনাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত হতে হচ্ছে। আপনার মেধা আর শ্রম নিংড়ে নিয়ে তারা দু-হাজার আর পাঁচশো টাকা দিয়ে ছেলের বিয়ের মণ্ডপ সাজাচ্ছে। আপনার জমানো টাকায় বিদেশে বসে ফুর্তি করছে। আর সমস্ত দিন সুপারির খোসা ছাড়িয়ে আমাদের মেয়েরা পাচ্ছে ত্রিশ টাকা। আশা কর্মীরা ইঞ্জেকশন প্রতি পাচ্ছে ছ-টাকা। রাত বিরেতে বাড়ী বাড়ী মানুষকে সার্ভিস দিতে গিয়ে ধর্ষিতা হয়ে মরছে। অঙ্গনওড়ারির রাঁধুনিদের বেতন মাসে এক হাজার টাকা- তাও নিয়মিত নয়। অসংগঠিত শ্রমিকদের অবস্থা ভয়াবহ। আরো অনেক অনেক বৈষম্যের শিকার আপনিও- সেটা আপনি মনে মনে ঠিকই জানেন।
তাই হে মানুষ, হে শিক্ষিত, অশিক্ষিত শ্রমিক মানুষ, 'শ্রমিক দিবস' মানে কমিউনিস্টদের হাতে লাল ঝান্ডা নিয়ে হাঁটা নয়। শ্রমিক দিবস একটি লড়াইয়ের নাম, যে লড়াই শ্রমিকরাও মানুষ এবং মানুষ হিসেবে তার অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করার দাবী আদায়ের লক্ষ্যে পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকদের একজোট হওয়ার দিন। চোখের ছানির মতো পুঁজিবাদও একপ্রকার রাষ্ট্রীয় ছানি এবং শ্রমিক দিবস অথবা শ্রমিক ঐক্য তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা একটি রাজনৈতিক ওষুধ। সময় থাকতে এই বোধটুকু মাথায় ঢুকিয়ে নিন এবং তারপর শ্রমিক দিবস বা ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেলে তাকে না হয় ছুঁড়ে ফেলে দিন। কিন্তু আগামী আরো কয়েক যুগ অব্দি আপনার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে 'শ্রমিক দিবসের', শ্রমিক ঐক্যের এবং লাল ঝান্ডার প্রয়োজন আপনার আছে, বন্ধু।
মহান মে দিবসের ইতিহাস
বিদ্রোহী কবির দুটো লাইন দিয়ে শুরু করি -
"তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।"
সভ্যতা তার নবরূপ পেয়েছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে আঘাতে। শ্রম দিয়েই পৃথিবীর অগ্রযাত্রা। অথচ শ্রমিক তার অধিকার হারা সভ্যতার শুরু থেকেই। ইটের ওপর ইট গেঁথে আকাশচুম্বী প্রাসাদে বসে যখন পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন বোনা হয়, ঠিক তখনও শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে বুকের রক্ত ঝরায়। বঞ্চিত খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস আজ ১৩২ বছর পেরোলো। আজ পয়লা মে। মহান মে দিবস।
শ্রমজীবী মানুষের স্বীকৃতির সূচনা সহজ ছিলো না। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষন থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এই দিনে বুকের রক্তে শ্রমিকরা আদায় করেছিলেন দৈনিক আট ঘন্টা কাজের অধিকার। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই সেদিন মালিকরা স্বীকার করেছিলেন, শ্রমিকরাও মানুষ। তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে।
উনিশ শতকের গোড়ার দিককার কথা। শ্রমিকরা তখন চূড়ান্তভাবে শোষিত। সপ্তাহের প্রতিদিনই গড়ে প্রায় দশ থেকে বারো ঘন্টার অমানবিক পরিশ্রম করতে হতো কিন্তু বিনিময়ে মিলতো নগন্য মজুরী। অনিরাপদ কর্ম পরিবেশে রোগ-ব্যাধি, আঘাত, মৃত্যুই ছিলো তাদের নির্মম সাথী। তাদের পক্ষ হয়ে বলার মতো, প্রতিবাদ করার মতো কেউ ছিলো না।
১৮৬০ সালে শ্রমিকরা মজুরী না কেটে দৈনিক আট ঘন্টা শ্রম নির্ধারনের দাবী জানায়। কিন্তু কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিলো না বলে এই দাবী জোরালো করা সম্ভব হয় নি।
সম্ভবত ১৮৮০-১৮৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা মালিক শ্রেণীর এই রক্ত শোষন নীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করে Fedaration Of Organized Trades And Labour Unions Of The United States And Canada। ১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় American Fedaration Of Labour। এই সংগঠনের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে।
১৮৮৬ সালের ১ মে- সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে এদিন রাস্তায় নেমে আসে। শিকাগোতে শ্রমিক ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক কাজ ফেলে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা, মিছিল, ধর্মঘট, বিপ্লবী আন্দোলনের হুমকি - সবকিছু মিলে উত্তাল হয়ে ওঠে পয়লা মে। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ, লুই লিং সহ আরো অনেকে শ্রমিকদের মাঝে পথকৃত হয়ে উঠেন। আন্দোলন চলতে থাকে।
৩ মে (অনেকের মতে ৪ মে), ১৮৮৬, সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হোন। আগস্ট স্পীজ সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ ভ্যানের কাছে একটি বোমা বিষ্ফোরণ হয়। এতে একজন পুলিশ নিহত হয়। পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা পরে রায়টের রূপ নেয়। এগারোজন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজ সহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুই লিং একদিন আগে জেলে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনেরো বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে উঠার আগে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন -
"আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে"।
২৬ শে জুন, ১৮৯৩, ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশ কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে অজ্ঞাত সেই বোমা হামলাকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায় নি।
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের "দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার" দাবী অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিবসটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে বিশ্বব্যাপী দিনটি ‘মহান মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শেষ করা যাক রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর 'ইশতেহার' কবিতার কিছু লাইনে -
“আমাদের কৃষকেরা
শূন্য পাকস্থলি আর বুকে ক্ষয়কাশ নিয়ে মাঠে যায়।
আমাদের নারীরা ক্ষুধায় পীড়িত, হাড্ডিসার।
আমাদের শ্রমিকেরা স্বাস্থ্যহীন।
আমাদের শিশুরা অপুষ্ট, বীভৎস-করুণ।
আমাদের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা, অকালমৃত্যু আর
দীর্ঘশ্বাসের সমুদ্রে ডুবে আছে।”
আমার আশাবাদ রুদ্রের মতোই -
“আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো।
সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো।
শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।”
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট