মানুষের দুঃখ আমি দেখিয়াছি (এক)
প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ০০:৫০
উখিয়ার একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাঁশ দিয়ে বাঁধা সিড়ি দিয়ে উঠছিলাম, কাঁধে আধ কেজি ওজনের হালকা একটা ব্যাগ। মাথার উপরে গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, যেদিকে চোখ যায় গাছপালার চিহ্ন নেই। গরমে সেদ্ধ হতে হতে পাহাড় বেয়ে উঠছি আর ভাবছি, আমি তো বাড়ি ফিরে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসবো, এই মানুষগুলোর আর যাওয়ার জায়গা নেই, দিনের পর দিন এই অসহ্য গরম এরা কীভাবে সহ্য করছে? পাহাড়ের মাঝামাঝি উঠে মনে হলো আর পারছি না, প্রচন্ড হাঁপিয়ে উঠেছি, ঘামে ভিজে কাপড়গুলো সব গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। শ্বাস নিতে থামলাম, ব্যাগ থেকে বোতল বের করে এক ঢোক পানি খেলাম।
ঠিক তখনই দেখি ছোট ছোট রোহিঙ্গা বাচ্চারা রিলিফের বড় বড় বাঁশের আটি কাঁধে নিয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। একেই বোধ হয় বলে সারভাইভাল ইনসটিংট, প্রচণ্ড বিপদে যে মানুষ তার আর শারীরিক কষ্টের বোধ থাকে না, সে জানে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে, পেছনে কিছু বাকি নেই। উপরে উঠে দেখি একই কাণ্ড। ছোট একটা বাচ্চা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে এনে বাবাকে ঘরের মেঝে বানাতে সাহায্য করছে, আমি ক্যামেরা তাক করতেই সে একটা ভুবন ভোলানো হাসি দিল। কয়েকটা বাচ্চা মিলে আঁটি বানিয়ে জ্বালানী কাঠ সংরক্ষণ করছে বর্ষাকালের জন্য। যদি সেরকম বর্ষা হয় এবং ভূমিধসে অথবা সাইক্লোনে এদের শেলটারগুলো মাটিতে মিশে যায়, তখন যে জ্বালানী কাঠের চেয়েও অনেক বড় দুশ্চিন্তা এসে দরজায় আছড়ে পড়বে তা এই নিষ্পাপ শিশুগুলো জানে না।
একজন প্রতিবন্ধী রোহিঙ্গা আমাকে দেখে নিজের গল্পটা বলতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তিনি কথা বলতে পারেন না, কিন্তু হাত পা নাড়িয়ে অভিনয় করে দেখালেন কীভাবে তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। অদ্ভুত বিষয় হলো তার শব্দহীন গল্পটা বুঝতে আমার এতোটুকু সমস্যা হলো না, ছোটখাটো বর্ণনাগুলো পর্যন্ত আমার মনের গভীরে পৌঁছে বিবেকের সর্বাঙ্গে সমানে লাথি/ঘুষি চালাতে লাগল। তিনি অভিনয় করে দেখালেন কীভাবে গর্ভবতী মেয়েদের পেটে লাথি মেরে তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে, কীভাবে একের পর এক গুলি করে মানুষ হত্যা করে লাশের পাহাড় বানানো হয়েছে, কীভাবে বুকে গুলি এবং হাতে ছুরির আঘাত নিয়ে তিনি পালিয়েছেন, বনে লুকিয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন, বাচ্চারা খিদের জ্বালায় কান্না করেছে, গাছের পাতা বাকল ছিঁড়ে খেয়েছেন, কলাগাছ চিরে পানি পান করেছেন, পোকামাকড়ের কামড়ে কষ্ট পেয়েছেন, বনের পথে চলতে চলতে গায়ের কাপড় খসে গেছে, হাত দিয়ে লজ্জা ঢেকে রেখেছেন।
তারপর বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন, খাদ্য/পানি/উষ্ণতা দিয়ে এই দেশ তাদের আপ্যায়ন করল। জিজ্ঞেস করলাম, 'আবার ফেরত যাবেন?' সাথে সাথে দুই হাতে কান ধরে, জিহ্বায় কামড় দিয়ে দুইদিকে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগলেন। আমি বললাম, 'কিন্তু আমরাও তো গরিব, কতদিন রাখব আপনাদেরকে?' তখন ইশারা ইঙ্গিতে বললেন প্লেনে চড়ে অন্য কোনো দেশে চলে যাবেন যদি কপালে থাকে, কিন্তু মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।
অনেক কথা বলা যেতে পারে, নিজেদের দারিদ্র্যের দোহাই দেয়া যেতে পারে, এদেরকে সুযোগ সন্ধানী বলা যেতে পারে, কিন্তু পেছনের যে বর্ণনা তিনি দিলেন তাতে কি ফিরে যেতে না চাওয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করা যায়? আপনি হলে ফিরে যেতেন? নিশ্চিত মৃত্যু এবং নির্যাতনের কথা জেনেও?
লেখক: শিক্ষক, অনুবাদক ও নাট্যকর্মী