মেয়েদের মুক্তি নেই!

প্রকাশ | ১৩ এপ্রিল ২০১৮, ০০:৪৫

সব ধরণের ক্রাইমেরই কিছু প্যাটার্ন থাকে। ক্রাইমের প্যাটার্ন দেখে তার মোটিভ চিহ্নিত করা যায়। নির্ভয়ার ক্ষেত্রে তা ছিল "মেয়েছেলের এত সাহস যে রাতে অনাত্মীয় পুরুষের সাথে একা বেরোয়?" ধর্ষণকারী তার ইন্টারভিউতে বলেছে এ কথা। এ হল পরিষ্কার পিতৃতন্ত্রের আত্ম অহংকার। আমি সেরা, আমি নিয়ম বানানোর হর্তা কর্তা বিধাতা। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের এত সাহস যে সে আইন অমান্য করে?

আসিফাকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্রাইমে ইনভলভ করে, তার মধ্যে নাবালক থেকে শুরু করে নারী পর্যন্ত সবাই আছে। বাইরে থেকে ডেকে আনা হয়েছে লোকজনকে। এ হল জাতিগত হিংসা। ধর্ষণ এবং খুনের বদলা খুন। পরিবারকে, বিশেষত নাবালককে তাতে এনগেজ করার অর্থ আমি চাই এই হিংসা পরের প্রজন্মে চারিত হোক।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম এক হওয়া সত্ত্বেও মেয়েরা ধর্ষিতা হয়েছেন। ভিন্নধর্মী হলে তো হয়েছেনই। সেখানে লড়াই ছিল দুই রাষ্ট্রশক্তির। কিন্তু আঘাত করা হয়েছে মেয়েদের যোনিতে, স্তনে।

মেয়ে বা ছেলে এক গোত্রে বা অন্য জাতে বিয়ে করলে খাপেরা বিধান দেন সে বাড়ির মেয়েকে নগ্ন করে গ্রাম ঘোরাতে, ধর্ষণ করতে।

সব রকম হিংসায়, লড়াইতে, মিথ্যে পিতৃতান্ত্রিক গর্বে, জাতিধর্মগত বা পারিবারিক বিদ্বেষে, নারীর যোনি হল সবচেয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তু। শিশু হোক বা পূর্ণযৌবনা, প্রথম আঘাত তাকেই লক্ষ্য করে আসে।

ধর্ষকদের বাঁচাতে উকিলরা একজোট হয়ে "জয় শ্রীরাম" ধ্বনি দিয়ে মিছিল করলে আমি অবাক হই না তাই। রামও তো পুরুষই আগে, স্ত্রীর যোনির শুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ করে তাকে পরিত্যাগ করা প্রবল পুরুষ। তার ভক্তরা আর অন্যরকম কী করে হবে? বিজেপির মন্ত্রীসান্ত্রী নিয়ে তো আরোই নিশ্চিন্ত। তাদের হিন্দুভোট বাঁচানোর দায় আছে।

আমায় নাড়িয়ে দেয় এই খবর যে মেয়েরাও হেঁটেছেন এই ধর্ষকদের বাঁচানোর সমর্থনের মিছিলে। সত্যি? মেয়েরাও ধর্ষককে বাঁচাতে চান? কারণ তারা তার ধর্মের লোক? জাতির? বাড়ির?

বলিহারি পিতৃতন্ত্রের থাবার জোর! প্রতিদিন পড়তে চাওয়ার জন্য, নিজের ইচ্ছেমত পোশাক পরার জন্য, হাসার জন্য, গান গাওয়ার জন্য, প্রতিবাদ করার জন্য বা কিছুই না করার জন্য, চরম পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, জাত, ধর্ম, এথনিসিটি, দেশের পায়ের তলায় পিষে যেতে যেতেও তারা পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাটিকে ওপরে তুলে রাখতে ভোলেন না। ধর্ষিতা হতে হতে পিতৃতন্ত্রের জয়গান গান। মার খেতে খেতে বোঝান মার খাওয়া আসলেই কত ভালো জিনিস!

এই দেশে, বা কোনো দেশেই, আসলে মেয়েদের মুক্তি নেই। তাদের এই-ই নিয়তি। যতদিন না সমস্ত মেয়েরা খারাপ হচ্ছে, থুতু দিতে শিখছে পিতৃতন্ত্রের সমস্ত নিয়মের ওপর, লাথি মেরে ভেঙে দিতে শিখছে তার সমস্ত ধাঁচা, যতদিন না মেয়েরা বুঝছে আসলে তারাই একমাত্র নিজেদের আপনজন; পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, জাত, ধর্ম, দেশ, কেউই তার আপন না, একমাত্র পাশের বাড়িতে চড় খেয়ে চুপ করে থাকা বউটি, বা গর্ভের দ্বিতীয় কন্যা সন্তান অ্যাবর্ট করিয়ে আসা পাশের ডেস্কের কলিগ, বা আসিফা, নির্ভয়া বা সুজেট, এরা ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই; ততদিন তার মুক্তি নেই।

ততদিন পিতৃতন্ত্র জিন্দাবাদ।

লেখক: প্রকৌশলী