৪র্থ অধ্যায়ের পরের অধ্যায়
প্রকাশ | ০৩ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:৩৪
পৃথিবীটা যে একটা জঘন্য জায়গা, তা একটা মেয়েকে খুব অল্প বয়সেই জেনে যেতে হয়। তাকে জানিয়ে দিতেও হয়, তার নিরাপত্তার স্বার্থে। প্রাকৃতিক কারণেই বয়োঃসন্ধিকাল থেকেই শারীরিক কিছু পরিবর্তন ঘটে। এ সময় থেকেই একটি মেয়ে গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়। তাই অকাল গর্ভধারণ, গর্ভপাত, বাল্যবিয়ে, যৌন নিগ্রহ সম্পর্কে তাকে সচেতন করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি ৩০ সেকেন্ডের আনন্দের জন্য ৩০ বছর যেন তাকে সাফার করতে না হয়, এ সাবধান বাণীর সাথে অতি আবেগের লাগাম টেনে ধরাটাও তাকে শিখতে হয়। ৯ম-১০ম শ্রেণীর বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের ৪র্থ অধ্যায়টি 'বাসায় পড়ে নাও' বলেই দায়িত্ব শেষ করা উচিত নয়।
বেশির ভাগ ব্যক্তির মধ্যেই এমন একটি ধারণা রয়েছে, এ অধ্যায়টি মেয়েদের সচেতন করছে, ইটস ফাইন। ছেলেদের আবার এখানে কী পড়ানোর আছে?
অবশ্যই আছে, অকাল গর্ভধারণ কিংবা গর্ভপাতের ফলে একজন কিশোরীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে ছেলেদেরও সমানভাবে সচেতন হতে হবে। কেন না, একজন ছেলে বা পুরুষের সাময়িক আবেগ/আনন্দ কিংবা লালসার শিকার হয়ে কোন মেয়ে গর্ভপাত কিংবা সন্তান জন্ম হলে তার দায়ভার সেই ছেলে/পুরুষের। এ শিক্ষা আমাদের দেশের ছেলেরা পায় না, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। পায় না বলেই এত ইভটিজিং আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নারীদের কাছে পৃথিবী হয়ে ওঠে জঘন্য স্থান।
গর্ভপাত মানে হত্যা, একটি নতুন জীবনকে হত্যা। আর যদি জন্মই দিতে হয় কোন সন্তানকে তার দায়ভার নিতে হবে। যদি সন্তানের দায়ভার নিতে না পারে কেউ, তবে আবেগের রাশ টেনে ধরতে হবে। এ শিক্ষা মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদেরকেও দিতে হবে।
এখন কিশোর অপরাধের ধরন বদলে যাচ্ছে। পর্নোগ্রাফ ও মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা থেকে নিতান্ত কিশোরও ইভ টিজার এমন কি ধর্ষকও হয়ে উঠছে।
তাই বয়সন্ধিকালীন সময়ের এই সেক্স এডুকেশন অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার কোনটি জানেন? নিতান্তই শিশুদেরকেও পৃথিবীর জঘন্যতা সম্পর্কে সচেতন করে দেওয়া। একটি শিশু, বয়স ধরুন, ৫/৬/৭/৮/৯/১০ বছর... যে হাসবে খেলবে, প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবে, সবার আদর কুড়িয়ে আকাশে ভাসবে... তাকেই কিনা জঘন্য ও নিষ্ঠুর সত্যের কথা বলে সচেতন করে দিতে হচ্ছে আজ। এ বড় কঠিন কাজ।
আপনারা জানেন, ২-৩ বছরের শিশুরাও আজ ধর্ষকদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। একটু বড় শিশুদের ভালো ও মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব। কিন্তু ২/৩ কিংবা ৫ বছরের একটি শিশুকে কী বোঝাবেন?
ভালো ও মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে টুকটাক সচেতনতা তৈরির কাজ করতে গিয়ে, ভিকটিমদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মাঝেমাঝে নিজের শৈশবের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমি সব সময়ই খুব ভালো, লক্ষ্মী, হাসিখুশি মিশুক বাচ্চা ছিলাম। সবার সাথে মিশতাম। সবার কোলে যেতাম। সবাই আমাকে অনেক আদর-ও করতো। কিন্তু সমস্যা হতো, এক প্রতিবেশী মামার কোলে গেলেই আমি চিৎকার করে কেঁদে ফেলতাম। এমন কি তার কোলেও যেতে চাইতাম না। সবাই অবাক হতো, এত ভালো বাচ্চাটা চেঁচাচ্ছে কেন? তানিয়া তো সবার কোলেই যায়, মেশে। ওর কোলে যেতে চায় না কেন? নিশ্চয়ই পছন্দ করে না। কেন তানিয়া, যাও না ওর কোলে, তোমাকে চকলেট কিনে দেবে ইত্যাদি।
কিন্তু আমি যেতে চাইতাম না। ঐ মামা আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেই আমি ঠাণ্ডা। আসলে তিনি আমাকে এত শক্ত করে জোরে ধরতেন যে আমি ব্যথায় কেঁদে ফেলতাম। আর এই কথাটা কাউকে বলতে পারতাম না। আসলে কী বলতে হয় তা জানতাম না। আমার বয়স তখন ছিল তিন কিংবা চার।
একদিন বিকেলে সবাই খেলছি। সেই মামা এসে উপস্থিত। তিনি আমাকে কোলে নিতে চাইলেন। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম, যদি ব্যথা পাই! আমার সাথে সাহায্যকারী মেয়েটি বললো, যাও, যাও। তো আমি মামার কোলে গেলাম, কিছুক্ষণ ভালোই ছিলাম, কোন ব্যথা পাচ্ছিলাম না। কিন্তু একটু পরেই তিনি আমাকে ভীষণ জোরে চেপে ধরলেন। আমিও ভ্যা চিৎকার। সেই চিৎকারে জোরেই উনি অপ্রস্তুত হয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন। অন্যরাও অবাক, এর কোলে গেলেই কেন চিৎকার করে!
এখন এতদিন পরে বুঝি, এটা স্পষ্টতই খারাপ আদর। যে স্পর্শে শিশু ব্যথা পাবে, ভয় পাবে, অস্বস্তিবোধ করবে সেটাই খারাপ আদর বা স্পর্শ। আমাদের দেশের সামাজিক পরিমণ্ডলে শিশুদেরকে সবাই ইচ্ছেমত কোলে নিচ্ছে বা আদর করছে। এটা আমরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখি। কিন্তু অনেক সময় শিশুরা কারো কারো কোলে যেতে চায় না, কান্নাকাটি করে, লুকিয়ে থাকে কেন তা আমরা ভেবে দেখি না। তখন উলটো শিশুটিকেই ঐ ব্যক্তির সাথে মিশতে জোর করা হয়। অথচ পাশ্চাত্যে তিন বছরের কোন শিশুকে তার বাবা-মা ছাড়া অন্য কেউ কোলে নিতে চাইলে সে মানা করে দেবে। সে বলবে, 'আমার বয়স তিন বছর হয়ে গেছে, আমি এখন আপনার কোলে যেতে পারবো না'।
বলছিলাম, বয়সন্ধিকালীন সময়ের ছেলে-মেয়েদের সেক্স এডুকেশন নিয়ে। কিন্তু এখন এক বছর থেকে ৫ বছরের শিশুরাও নিরাপদ নয়। তাদেরকেও সচেতন করার দরকার আছে। সে বাবা-মা ছাড়া অন্য কারো কোলে যাবে না, তাকে শিখিয়ে দিতে হবে। ছেলে শিশু হোক আর মেয়ে শিশুই হোক।
আর আমাদেরও শিশুদের সাথে আচরণ করার সময় একটু সচেতন থাকা দরকার। শিশুর বাবা-মার অনুমতি ছাড়া কোন শিশুকে স্পর্শ করবেন না, যদি পেশায় চিকিৎসক হন, তবুও না। যদি স্পর্শ করতে হয় শিশুর বাবা-মায়ের সামনে স্পর্শ করবেন। কোন শিশুকে আদর করার জন্য বা কোলে নেবার জন্য জোর জবরদস্তি করবেন না। শিশুদের সচেতন করার চাইতে আমরা বড়রা যদি সচেতন হই, তাহলে এ পৃথিবীটা যে সুন্দর একটি জায়গা এই ধারণা নিয়েই ওরা বড় হতে পারবে।
লেখক: শিক্ষক