অন্যের নির্যাতনে কখনো চুপ থাকবেন না
প্রকাশ | ০১ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:৫০
একটা ভিডিও দেখলাম, কোন এক সভায় তসলিমা নাসরিনকে কিছু লোক মারার চেষ্টা করছে, কিছু লোক থামানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মার খাচ্ছে। যে ভিডিওটি শেয়ার দিয়েছে, তার ক্যাপশন হচ্ছে, বেশ হয়েছে, ব্লাডি ফেমসিকার, অন্যদের রিলিজিয়ন নিয়ে বাজে কথা বললে এমনই হবে।
তসলিমার উপর অ্যাটাক হওয়াতে অবাক হইনি। গত ২০ বছরে তসলিমাকে মাইর দিতে হবে, এটা একটা আইডলজি হয়ে গেছে, যেমন জাফর ইকবাল নাস্তিক, এমন কি মোশাররফ করিমও নাস্তিক (ক্যাম্নে, সে উত্তর অধিকাংশই জানেন না) তসলিমাকে যারা দেখতে পারেন না, তাদের মিটিং এ যাওয়ার লজিক টা বুঝলাম না। মাইর দিতে গেছে?
আমি দুখ পেয়েছি, আমার বন্ধুর কথায়। একজন নারীকে পথেঘাটে মারধর করতে দেয়ার প্রশ্রয়ের মধ্যে যে বিপদ আছে, সেটা তিনি ধরতে পারছেন না। কাল উনাকে মাইর দেয়ার জন্য অজুহাত বের হবে। বের হবার অবশ্য দরকার নেই, এখনি আছে। উনি একজন গাইনি ডাক্তার, উনি টাকার জন্যে সিজার অপারেশন করেন, এই ইস্যুতে উনাকে মাইর দেয়া যেতে পারে (আদৌ করেন কি না, সে প্রমাণের দরকার কি? দেশে কি সিজার এম্নে বাড়ছে? আর সিজার তো গাইনি ডাক্তারই করে)।
আমি বরিশালে ডাক্তারের উপর হামলার পোস্ট দেয়াতে একজন কমেন্টে সিলেটে নবজাতকের লাইফ থ্রেটেনিং মিসম্যানেজমেন্টের লিংক দিয়েছেন। সিলেটের ডাক্তারের দোষে কেন বরিশালের ডাক্তার পিটাইতে হবে এটা আমি জিজ্ঞেস করি নাই। মানুষকে বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে, এটা যে একটা ভুল ধারণা সে আমি বেশ বুঝে গেছি।
কিছুদিন আগে, একটা পোস্ট দেখলাম, একজন মেয়ে ডাবের দোকানে ডাব খাচ্ছিল। সেখানে একদল কিশোর মাদ্রাসা ছাত্রের দল এসে হাজির। তারা মহিলাকে বলছে, দাঁড়ায় পানি খাওয়া নিষেধ, আপনি বসে ডাব খান। উনি হতভম্ব, এই ফুটপাতে আমি কোথায় বসবো? মাদ্রাসার ছাত্ররা মাথা নাড়েন, সেটা উনাদের দেখার বিষয় না, ইসলামে নিষিদ্ধ কাজ উনারা করতে দিবেন না। মহিলা রেজিস্ট করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে ডাব ফেলে চলে এসেছেন। মাইন্ড ইট, আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানি খাবেন, এই স্বাধীনতা অচিরেই চলে যাচ্ছে।
কোন মেয়ে যখন মুখে বা লেখায় সমাজের, ধর্মীয় রীতির কোন অসংগতি নিয়ে কথা বলেন, তিনি প্রথম গালি খান তসলিমা হইছ? মেয়েটি অপমানিত হন, ছিঃ, তসলিমা হতে যাব কেন?
আর আপনি যদি আমার মত গবেট হন, তাহলে বুঝবেন, তসলিমা সেইজন যে সেই আমলে আমরা ভাল বিয়া এবং বাচ্চার চিন্তার যুগে ছিলাম, ফেসবুক ছিল না, ভাবনার অক্ষরে রূপান্তরের গণ্ডি একমাত্র লেখকদের ছিল, তখন থেকে নারী নিগ্রহের ব্যাপারে আওয়াজ তুলে গেছেন। আপনি তাকে যতই অপছন্দ করেন, তার মত 'কুখ্যাত' আর একজনও হতে পারে নাই। এই সমাজ এখনো যখন মেয়েদের দাবায়া নিজেদের কম্ফোর্ট নিশ্চিত করতে চায়, তাদের মনে যে প্রতিরোধের আশংকা আসে, সেটা তসলিমার রূপ ধরে আসে। তসলিমা যেইদিন মরবে, আপনার কথায় তসলিমার ছায়া দেখে আঁতকে ওঠার ভয়টাও মরে যাবে।
আমার মধ্যে একটি দোষ আছে। আমি সহজে কোন কিছুতে দোষ খুঁজে পাই না। মোটিভ পাই। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে পরস্পর বিরোধী মানুষ থাকেন। কেউ উদার, কেউ রক্ষণশীল, কেউ প্রতিবাদী, কেউ নির্যাতিত, কেউ তর্কবাগীশ, কেউ ছিদ্রান্বেষী, কেউ গৃহিণী, কেউ কর্মজীবী, মহাধার্মিক, মহানাস্তিক। আমার বেশিরভাগের কথা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। লোকে নারীবাদী হতে চায় না, তাতেও দোষ দেখি না। বাপের ঘরে বড় হয়ে স্বামী ঘরে রাঁধিয়া খাইব, এত আরাম স্বাধীনতার নামে ছাড়ে কোন উল্লুকে? আর দুইটা ভাত কাপড় দিয়ে নিত্যদিন ৪ বেলা ফ্রেশলি কুকড খাবার, বিছানা, বিছানাসঙ্গীর সিস্টেমই ভাঙ্গার দরকারটা পড়লো কিসে? বেশ ভাল চলছে। চলুক।
অস্ট্রেলিয়ান একটা ব্যাপার আমার খুব পছন্দ, সেটা হল ডাইভারসিটি। রেডফার্ন ষ্টেশন কনকোর্সে দাঁড়ালে আপনি দেখবেন, কত রকম মানুষ। সাদা, বাদামী, একটু সাদা, বেশি সাদা, শ্যামলা, উজ্জল কালো, ভয়াবহ কালো, বডিবিল্ডার, মরবিড অবেস, ডিজেবেল, স্কেটিং এ চড়া। আমার কাউকে কুৎসিত লাগে না। মনে হয় বেশ তো। এই যে এত রঙের মানুষ, এই তো বেশ সুন্দর। আমরা পাশাপাশি ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরি। সমস্যা হয় না তো কোন।
ঝামেলা তখন শুরু হবে, যখন আমি সুদানের লোকটা কে নিগ্রো বলব, আমাকে কেউ ব্লাডি ইন্ডিয়ান বলবে, আমি একজন হোয়াইটকে রেসিস্ট বলে দোষারোপ করব। যদি কেউ কালো লোকটিকে হ্যারাস করে, আর আমি বলি কাল্লুরে পিটা, এইগুলা ড্রাগ ডিলার (অনেকেই) আরেকদিন আমাকে আইএস বলে মাইর দিবে, হিজাবি যেহেতু আইএসের সাথে তো লিংক আছেই। আছে না?
এই সমাজে নারীবাদী, সংসারী, গৃহিণী, কর্মজীবী সবার রোল আছে। কোন সিনেমাতে যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রেমিক প্রেমিকা ভিন্ন আর কোন চরিত্র না থাকে, মুভিটা ৫ মিনিটও দেখবেন না। কেন না সেটা বোরিং, বৈচিত্র্য নেই।
অন্যের নির্যাতনে কখনো চুপ থাকবেন না, অ্যাটলিস্ট ব্লেমিং করবেন না। আপনার মতে তসলিমা আবোলতাবোল বলেন, আপনার লিমিটও আপনার বক্তব্য ক্লিয়ার করা পর্যন্ত, নট ফিজিক্যাল অ্যাটাক। তাকে কেউ শারীরিকভাবে নির্যাতন করলে আনন্দিত হবেন না। কারণ আপনাকে নির্যাতন করার জন্যেও কারণের অভাব নেই। আপনার প্রোফাইল দিন, নির্যাতন করার মোটিভ বের করে দিচ্ছি।
লেখক: চিকিৎসক