একটু স্বাধীনতা কি দেয়া যায়?
প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০১৮, ২৩:৪১
স্বাধীনতা শব্দটি শুনতে যত সহজ, যত অল্প মনে হয়, এর গভীরতা কিন্তু ঠিক ততটুকু নয়। 'স্বাধীনতা' আদিগন্ত বিস্তৃত একটা শব্দের নাম। ক্ষমতামত্ত 'স্বাধীনতা' শব্দের ইজারাদাররা বারবার এসে গলা চেপে ধরে। জোর করে স্বীকার করাতে চায়, আমরা সকলেই পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছি। যারা স্বাধীনতার সমালোচনা করেন, চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন আমরা কোথায় কোথায় কতখানি পরাধীন তখনও এরা স্বীকার করেন না। এরা চান চোখ বন্ধ করে জ্বী স্যার জ্বী স্যার করে মুখে ফেনা তুলে ফেলা, তাহলেই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হওয়া যায়।
'রাজাকার' শব্দটির মতো এমন ভারী নোংরা শব্দটির যত্রতত্র ব্যবহার করে এরা শব্দটিকেও খেলো বানিয়ে ফেলেছেন। যেকোন কিছুর সমালোচনা করলেই উগ্র-জাতীয়বাদীরা সমালোচনাকারীকে 'রাজাকার' বলে গালি দেন। দেশের জন্য যারা সত্যিকার অর্থেই কাজ করেন, দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন তাদেরকে 'রাজাকার' বলে গালি দিয়ে নিজের ভাগের শতভাগ নিশ্চিত করে টক-শোতে গালভরা কথা বলে এসি ২০ এ নামিয়ে কম্বল টেনে ঘুমান। আর কথিত 'রাজাকার'রা তখন রাত জেগে পথের ওপর ঘুমানোদের খাবার কিনে দেন, ছিন্নমূল বাচ্চাদের নতুন জামা কিনে দেন, রাস্তায় পড়ে থাকা পলিব্যাগ-নোংরা আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলেন। তারপর আযান দিলে ভোরের দিকে এসে দু'চোখের পাতা এক করেন।
আমাদের দেশে এখন দেশপ্রেমের অবস্থা এই। দেশপ্রেম এখন আর দেশ ও মানুষকে ভালবাসা নয়। দেশপ্রেম মানে প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনীতি, টক-শো'র গেস্ট, স্বাধীনতার ইজারাদার হওয়া। দেশপ্রেম মানে দেশের কোথায় কোথায় খারাপ খবর তৈরি হচ্ছে, সেগুলো বেমালুম চেপে গিয়ে বড় বড় ফ্লাইওভার, ফুটওভার ব্রিজ, সেতু-মেট্রোরেল নিয়ে কথা বলা। দেশপ্রেম মানে বিউটির ধর্ষণের খবর ভুলে যাওয়া, ৪ বছরের বাচ্চার ধর্ষণের খবর দেখেও না দেখার ভান করে বিশ্ব অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কততম সে বিষয়ে দীর্ঘ কলাম লেখা। দেশপ্রেম মানে সপ্তাহে ছয়দিন বাদুড়ঝোলা হয়ে কম করে এক কোটি মানুষের অফিস ফেরা গল্প না বলে দেশে প্রতিদিন ১৬ নাকি ২০ হাজার নতুন গাড়ি ঢাকার রাস্তায় নামছে তার ওপর দীর্ঘ বক্তৃতা করা। দেশপ্রেম মানে বস্তির আগুনে পোড়া ২৫ হাজার মানুষের মাথাগোঁজার ঠাঁই হারানোর গল্প নয়, ৭০ টাকা কেজি চাল কেনার অসামর্থ্যের গল্পও নয়। দেশপ্রেম মানে গ্লোরিয়া জিনস, পিজ্জা হাটের স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবসের লাল-সবুজ কাপড় পরা পার্টি।
আপনারা নিজেরাই দেশের ভাল-মন্দ বুকের গহীনে লালন করেন না। আপনাদের চেঁচামেঁচিই প্রমাণ করে, আপনারা অ্যাটেনশন সিকার পদলেহী পতঙ্গবিশেষ। রাজাকারদেরই রাজাকার ডেকে প্রতিক্রিয়া দেখান হে প্রতিক্রিয়াশীল জনতা, যে কাউকে রাজাকার ডাকবেন না। সুযোগ পেলে আপনিই সবার আগে রাজাকারের নাম ভূমিকায় নামবেন, এসব সাধারণরা বোঝেন। দলকানা, উগ্র-জাতীয়তাবাদ দেশের যতখানি ক্ষতি করে, তার এক সিকিও মঙ্গল করে না। দেশ সবার, দেশের গৌরব সবার, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস, গণহত্যা দিবস সবার। আপনি ইজারাদার হলেও দেশের মানুষ তাদের বুকের ভেতর শৈশব থেকে ধারণ করা অনুভূতির ইজারা আপনাকে দেয়নি। আপনার দামি ফোন, ঘরের এসি, টক-শো'র গল্প সাধারণ জনতার কাছে বেচবেন না। সাধারণরা একটু খেয়ে পরে, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পতপত করে উড়তে থাকা পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি" গাওয়ার মধ্যেই জীবন-মরণ সঁপে দিয়েছে। যাদের পা চাটলে আপনার সুবিধা হয় চাটেন, সবাইকে আপনার মতো চাটাচাটি করতে বাধ্য করবেন না।
দেশপ্রেম মানে যে যতখানি দেখাতে পারে। আমরা দেখাতে পারি না বলে ভয় লাগে, না জানি কখন রাজাকার বলে ফাঁসি চেয়ে বসেন। অথচ দেশের মানুষের জন্য কত পরিকল্পনা করি, বিদেশ না গিয়ে, নিজের ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে কিভাবে দেশের তথা সমাজের তথা অনগ্রসর মানুষদের গতানুগতিক ধারায় এনে কাজ করা যায় সেকথা ভাবি। অথচ মানুষের দুর্ভোগের কথা বললে আমরা দেশদ্রোহী, খেটে খাওয়া মানুষদের পেটে লাথি মারার গল্প বললে দেশের শত্রু বলা হয়, ধর্ষণের খবর চাউর করলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগ আনা হয়, নারী স্বাধীনতার কথা বললে আমরা চাকরি করতে পারছি এমন উদাহরণ টেনে আনা হয়। আপনারা একেকজন নন্দলাল, আপনাদের জন্যই এখনো অবধি আমরা ঝকঝকে আলোর মুখ দেখতে পারছি না।
অথচ যে আমার কথা বলা হচ্ছে, সে আমিও কি স্বাধীন? যা ইচ্ছে লিখতে পারি? যেমন খুশি চলতে পারি? আচ্ছা খুশির কথা বাদই দিলাম। নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলতে পারলেই ভাবব আমি স্বাধীন, গরমে আরামদায়ক পোশাক পরে রাস্তায় বেরোতে পারলেই আমি স্বাধীন, নিজের পছন্দমতো একটা ক্যারিয়ার করতে পারলেই বুঝবো আমি স্বাধীন।
স্বাধীনতার ইজারাদারদের কাছে করুণ আকুতি, এই অধমকে এই এটুকু স্বাধীনতা কি দেওয়া যায়? গলা চেপে না ধরে এই স্বাধীনতাটুকু চাই বলার স্বাধীনতাটুকু কি দেওয়া যায়?
লেখক: লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী