মোশাররফ করিম সমীপেষু
প্রকাশ | ২৪ মার্চ ২০১৮, ১৭:৩২
প্রিয় মোশাররফ করিম,
আপনি সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
আপনার অনুষ্ঠানে আপনি একটি সচেতনতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, কোন নারী বা কোন শিশুকে যেন কোন রকম হেনস্থার শিকার হতে না হয়, যৌন নির্যাতন না হয়, যেন আমাদের সবারই একটি স্বাধীনতা থাকে, মন খুলে বাঁচবার। আপনি দেখাতে চেয়েছিলেন, দোষটা নির্যাতিতার নয়, দোষটা নির্যাতকের। নির্যাতিতার দোষ অন্যতম কিসে ধরা হয়? পোশাকে। সে সালোয়ার পড়ুক কি শাড়ি, সে ফ্রক পড়ুক কি ফতুয়া, সে মাথায় হিজাব পড়ুক কি ওড়নাটা কাঁধে ঝোলাক, সব রকম মেয়ে, সব বয়সী মেয়ে, কোন না কোন হেনস্থার শিকার হয় বিভিন্ন স্থানে। আপনি দোষটা দিয়েছিলেন যেখানে দেয়া উচিত - পার্ভার্টদের প্রতি, যারা নিজের কুপ্রবৃত্তির অপরাধগুলো ঢাকে ভিকটিমদের প্রতি আঙ্গুল তুলে।
আপনি বোরকা শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন। আপনি বুঝিয়েছিলেন যে আপাদমস্তক শরীর ঢেকেও আক্রমণগুলো হয়, - আপনি এতে বুঝিয়েছিলেন, পোশাক পার্ভার্টদের দূরে রাখে না। এটা বললেন, - আর হয়ে গেলেন ইসলাম অবমাননাকারী; হয়ে গেলেন নাস্তিক। (নাস্তিক শব্দটার মানে বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই অদ্ভুত কিছু একটা, - কাউকে নাস্তিক ট্যাগ দিলেই হলো, তাকে আঘাত করার সবরকম রাস্তা তখন খুলে যায়)! যারা এইসব বলছে আর ছড়াচ্ছে, তাদের মাথাতে থাকে, আপনি তাহলে বোধকরি বোরকা, হিজাব, পর্দাপ্রথা, পোশাক শালীনতার বিরুদ্ধে বলে ফেললেন; -আমি দুঃখিত, খুব দুঃখিত, এইসব মানুষেরা ঠিক একই কাজটাই করছে যেমনটা তারা নারীদের বিরুদ্ধে করে থাকে। যে লেবাসেই থাকুক নারী, এরা কুদৃষ্টি দেবেই, কুকথা শোনাবেই বা কুকাজ করতে চাইবেই! তেমনই, আপনি যেমনটি বলে থাকুন না কেন, এরা একটা ছুতো বের করে আপনাকে আক্রমণ করবেই! ফেসবুকে করছে, আপনার গ্রামের বাড়িতে আক্রমণ করেছে শুনলাম, আপনাকে বিভিন্ন রকমের হুমকি দিতেও এদের বাধবে না!
আপনি বলেছিলেন মনের উন্নয়নের কথা; আপনি বলেছিলেন, জিহাদের অর্থের কথা - প্রথম জিহাদ আমাদের, আমাদের মনের অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ, আমাদের মনের আলোকে লালন করার যুদ্ধ। ইসলাম ধর্মের এমন একটি চমৎকার শিক্ষাকে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আপনি জনমানুষের কাছে তুলে ধরেছেন, - সেটা সেই পার্ভার্টগুলো দেখবে না - তাহলে তাদের কুযুক্তিগুলো মাটি হয়ে যায় যে! আর তাহলে তাদের মনের অন্ধকারগুলো বাইরে চলে আসে যে! তাহলে যে তাদের নিজেদের কুপ্রবৃত্তিগুলো নিজেদের কাছেই স্বীকার করতে হয়ে যে, তাহলে অন্যের প্রতি আঙ্গুল তোলার মতো সহজ কাজ ছেড়ে নিজেকে সচেতন আর দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়বার কঠিনতম কাজগুলো করতে হয় যে!
আমি আপনার কাছে দুঃখিত, এদের সবার হয়েই আপনার কাছে দুঃখিত। আর আমি দুঃখিত তাদের হয়েও, যারা আপনার এই ক্ষমা চাওয়াটাকে ক্ষুদ্র করে দেখছে, আপনার ভীরুতার অপবাদ দিচ্ছে। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে আমাদের প্রিয় মানুষ জাফর ইকবালের উপর হামলা হয়ে যায়, - কারণ তার একটি শিশুতোষ বইতে একটি নাম ব্যবহার করার জন্য! মানুষ সে বই পড়েও না, না পড়েই আঙ্গুল তোলা হয়, সেই বইতে নাকি ধর্ম আর নবীর প্রতি অবমাননা দেখানো হয়েছে! তাতেই উস্কে উঠে চলে আসে একজন অস্ত্র হাতে; সবাই অস্ত্র হাতে নেয় না, কিন্তু অসংখ্য মানুষ সেই অস্ত্রধারীকেই বাহবা দিতে থাকে। তেমন আপনারও অনুষ্ঠান কারো দেখতে হয় না, আপনার নামে অপবাদ ছড়িয়ে যায়, - যে অপবাদগুলো যুক্তিতে টেকে না, কিন্তু এই মানুষগুলো যুক্তি শুনেছে কবে?
আপনি যে কন্ঠটুকু তুলেছেন, - আপনার এই সাহসটুকু আজকে অনেকেই দেখছে না।
আপনি যে বিনয়ের সাথে ক্ষমার মোড়কে আপনার অবস্থানটুকু আরেকবার জানিয়েছেন জনসম্মুখে, এই পাদটীকা জানানোটা যে আপনার কাছে জরুরি মনে হয়েছে, নাহলে আপনি বা আপনার প্রিয়জনেরা হয়তো ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারেন, এই ভাবনাটা যে আপনার ভাবতে হয়েছেন, সেটা আপনাকে মোটেও কাপুরুষ করে না।
আমি প্রার্থনা করি, আপনার আকাশের এই কালোমেঘ ক্ষণস্থায়ী হোক, আমি প্রার্থনা করি পুরো বাংলাদেশেই এই যে - ধর্মের আলো নয়, বরং ধর্মীয় উন্মাদনার- কালোমেঘ ছেয়ে আছে, সেটি অচিরেই উবে যাক! কিন্তু - যাবে না, যতদিন না এদের দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি হয়, যতদিন না ধর্মীয় আলোচনাগুলো মানবিক আলোতে না হয়, - যতদিন না আমাদেরই ইসলামিক যে শিক্ষা, সেই যে নিজের আত্মিক জিহাদ, সেই আত্মউন্নয়ন না হয়, - ততদিন আপনি এই যে কণ্ঠ তুলেছেন, সামাজিক সচেতনতা ছড়াতে চেয়েছেন, সেটাই আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা আর সাহসিকতার একটি অনন্য সাধারণ প্রতিফলন!
আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
আপনার কর্ম ও কণ্ঠ - সুরক্ষিত থাকুক সে সবও!
শুভেচ্ছা রইলো।
লেখক: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট