সব মাতৃভাষাকে যেন শ্রদ্ধা করতে শিখি
প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:১১ | আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:১৬
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে আজ অন্য আরেকটা গল্প শোনা যাক।
তামিল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা। ভাষাবিদদের ধারণা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার থেকেও বহু প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় ভাষাগুলি, এবং আশ্চর্যজনকভাবে এদের স্ক্রিপচারে খুবই কমসংখ্যক বর্ণ থাকা সত্ত্বেও লিখিত এবং কথ্য, দুই রূপেই এখনো অতিমাত্রায় জীবিত। আমাদের 'পপুলার বিলিফ' যে বাঙালিই একমাত্র ভাষা আন্দোলনের জন্য রক্ত দিয়েছে। আসুন, সুদূর তামিলনাড়ুর ভাষা শহীদদের গল্প শুনি।
তামিলে ভাষা আন্দোলনের জনক বলতে হয় পেরিয়ারকে। অবশ্য তিনি আরো বহু আন্দোলনের জনক। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী, অস্পৃশ্যতা-বিরোধী আন্দোলন। তিনি নিজে নাস্তিক ছিলেন, এবং সাম্যবাদী। বহু মন্দিরে দলিতদের প্রবেশাধিকার চালু হয় তার আন্দোলনের ফলে। যাই হোক, তামিল ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৩৭ সালে, যখন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম প্রভিন্সিয়াল ইলেকশন হয়। জাতীয় কংগ্রেসের নীতি অনুযায়ী ১৯৩৮ এর এপ্রিলে মাদ্রাজ প্রভিন্সের সব স্কুলে হিন্দিভাষা আবশ্যিক করা হয়। এর প্রতিবাদে সমস্ত প্রভিন্স জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। লং মার্চ, ধর্ণা এবং প্রতিবাদ মিছিল চলতে থাকে প্রভিন্সের সমস্ত বড় শহরে। পেরিয়ার নিজে এর নেতৃত্ব দেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল এই প্রতিবাদে মেয়েদের উপস্থিতি, ১৯৩৯ এ আলাদা করে তামিল মেয়েদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়।
নবনির্বাচিত কংগ্রেস সরকার এই আন্দোলনকারীদের সাথে প্রায় ব্রিটিশ সরকারের মতই আচরণ করে। শয়ে শয়ে আন্দোলনরত পুরুষ এবং মহিলাদের গ্রেফতার করা হয়। থালামুত্থু এবং নটরাজন নামক দুই যুবক জেলেই মারা যান। এনারা দীর্ঘকালব্যাপী তামিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। এরপরে বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন ভাষার জন্য। কিন্তু তামিলনাড়ু থালামুত্থু আর নটরাজনকে ভোলেনি। আজও তামিলনাড়ুর যেকোনো শহরে এই দুই যুবকের নামাংকিত রাস্তা দেখা যায়। যাই হোক, ১৯৩৯ এ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সারা ভারতবর্ষে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগ করে এবং ১৯৪০ এ, ব্রিটিশ সরকার এই অত্যাবশ্যক হিন্দি শিক্ষা আইন তুলে নেয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয় স্বাধীনতার পরে। এই পর্যায়ের নেতৃত্ব দেন আন্নাদুরাই। নতুন দেশী সরকার যখন হিন্দিকে জাতীয় ভাষা করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, সর্বশক্তি দিয়ে তাকে রুখে দেয় দক্ষিণদেশের প্রবল বিরোধিতা। বছরের পর বছর এসেম্বলির বাইরে এবং ভেতরে, তারা লিটার্যালি আন্দোলনের ব্যারিকেড গড়ে রাখেন হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৫'র ২৬ শে জানুয়ারি অফিসিয়ালি হিন্দি ভাষা সমগ্র দেশের জাতীয় ভাষা হওয়ার দিন। পুরো জানুয়ারি জুড়ে তামিলনাড়ুতে প্রতিবাদ আন্দোলন চলে। এই আন্দোলনে মূলত অংশ নেয় সাধারণ মানুষ এবং ছাত্ররা। সরকার একে অত্যন্ত নির্মম হাতে দমন করে। ২৭শে জানুয়ারি রাজেন্দ্রন নামে এক ছাত্র চিদাম্বরমে আন্নামালাই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
রাজেন্দ্রনের মৃত্যু ছাত্রদের আন্দোলনকে তীব্রতর করে। ২৭শে জানুয়ারি থেকে ছাত্ররা অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের ডাক দেয়। রাজ্য সরকার আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হলে আর্মি এবং সিয়ারপিএফ নামানো হয়। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫, আহত শতাধিক। এই সংখ্যা ছাড়াও বহু মানুষ স্বেচ্ছায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দেন। আন্দোলন এমন পর্যায়ে যায় যে ইউএন আলাদা করে এর ওপরে একটি আলোচনা আবাহন করে।
এই প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে পড়ে সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে ইংরাজিকেও দেশের অফিসিয়াল ভাষা রাখা হবে, আপাতত। পরে, ১৯৬৭ তে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঘোষণা করেন যে ইংরাজি বরাবরের মত দেশের অফিসিয়াল ভাষা থাকবে। আজ অবধি কোন সরকার সে বক্তব্য বদলানোর সাহস করেন নি।
দক্ষিণ ভারত থেকে বেড়িয়ে ফিরে আপনি, সংস্কৃতিবান কোলকাতার বাঙালি যখন বলেন, ওদের ভাষা তো টিনের কৌটোয় পাথর ভরে নাড়িয়ে দেওয়া ভাষা; তখন একটু মনে রাখবেন, আজ আপনার ছেলে যে স্কুলে অত্যাবশ্যিক হিন্দি পড়ছে না, তা এই পাথর নাড়ানো ভাষা বলা লোকগুলোর জন্যই। তাদের মায়েরা নিজের সন্তানের রক্ত দিয়ে আপনার সন্তানের মাতৃভাষা শেখার ও বলার অধিকার সুনিশ্চিত করেছেন।
আজ মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার হোক, আমরা যেন সবার মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা করতে শিখি।
লেখক: প্রকৌশলী