অবাধ্য ছেলেমেয়েরাই পৃথিবীকে মুক্তি দিবে
প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪১
আমার ভাই আর আমার বয়সের তফাৎ সাড়ে নয় বছর। যখন ভাই হয়, আমার অনেককিছুই বোঝার বয়স হয়েছে। মা বলেছিলেন, তুমি যাতে একা না হয়ে যাও তাই ভাই আনবো আমরা। ভাই-ই আনবো কী করে শিওর হল মা? মা শিওর ছিল ভাই-ই হবে, কারণ মা স্থানীয় কোন মন্দিরের জলপড়া খেয়েছিল। গর্ভবতী মহিলার তিন মাস গর্ভ হওয়ার মধ্যে খেতে হয় জলপড়া। সকালে উঠে কোনো মেয়ের মুখ না দেখে চান করে খেয়ে নিতে হয় টপ করে। মেয়ের মুখ দেখতে নেই এটাও আমি জানতে পেরেছিলাম, কারণ পাশের বাড়ির এক পিসির সেই জলপড়া খেয়েও মেয়ে হয়। তার কারণ পিসি সেদিন তার বড়মেয়েকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল রাতে। সকালে উঠে মেয়ের দিকে চোখ গেছে মায়ের! নিয়ম না মানলে কী আর পুত্রসন্তান এমনি এমনি হবে?
আমি ছোটবেলায় খুবই বাধ্য, ভালো মেয়ে ছিলাম। মন দিয়ে পড়াশোনা করতাম, সময়ে নাচের স্কুলে যেতাম। গান গাইতে বসতাম সকালে উঠে। ছবি আঁকতাম দুপুরে। কারোর কথার অবাধ্য ছিলাম না। মায়ের শুধু ভাই-ই চাই, বোন চাই না দেখে বহুদিন মনে হয়েছে আমি কি খুবই খারাপ? মা কেন মেয়ে চায় না তবে? খুবই খারাপ মেয়ে আমি? বড় হয়ে প্রথম যে ফাদার ফিগার আসেন আমার জীবনে, অসাধারণ একজন দাদা, তার দুই কন্যা ছিল। আমি তাকে, অদ্ভুত ভাবে, প্রথম পরিচয়ের কিছুদিন পরে জিজ্ঞেস করি, আপনার কোনদিন মনে হয় নি দ্বিতীয়টি পুত্র হলে ভালো হতো? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ধুর এইটাকে তো আকাশ পাতাল ভালোবাসি! ছেলে হলে এইটা থাকতো না তো! আহা, দুই মেয়েও তবে ভালোবেসে নেয় কেউ জীবনে! সেই দাদার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তিনি আমায় মাকে মাফ করে দিতে সাহায্য করেন। দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট হলে জগতে সবাই সকালে উঠে মেয়েছেলের মুখ না দেখে জলপড়া খায় না তবে! পৃথিবীটা তবে অতও মন্দ না!
খাপ বলেছে, কোট করি কী বলেছে, মেয়েরা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করবে কী! আমরা মেয়েদের পড়ার জন্য বিশ পঁচিশ পঞ্চাশ লাখ টাকা খরচ করি, সেই মেয়ের আবার নিজের বিয়ে করার অধিকার কী! আমরা কী সব তবে মূর্খ? এত টাকা এমনিই খরচ করে যাবো?
অধিকার! অধিকার ফলানো! আমি জন্ম দিই। আমি মানুষ করি। আমি পড়াই। আমি খাওয়াই। পরিবর্তে তুমি কী দেবে? আনুগত্য। সেবা। আমার জিন পরবর্তীতে বয়ে নিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা। এই হচ্ছে মোটামুটি কথা। আনুগত্যের দাবী হচ্ছে পৃথিবীর সব অপরাধের মূলকথা। পরিবার, ধর্ম, ইজম, সমাজ। ক্ষমতাশালী, সংখ্যায় বা বৈভবে, চায় প্রতিটি ইনডিভিজুয়াল তার সামনে মাথা নত করে থাকবে, তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। আমি মা হই, আমার কথা শুনতে হয়। প্রত্যেক বাড়িতে মায়েরা বলেন। বলেন না? এই আনুগত্যের দাবী থেকে বেরোতে অনন্ত সময় লাগবে বা কখনোই বেরোনো যাবে না। প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি বিশেষভাবে পলিটিক্যালি ইনক্লাইনড বা পাঁড় ধার্মিক পরিবার, সকলেই তার সন্তানকে নিজের মতানুসারী তৈরী করতে চান। একই কারণে আমাদের সমাজে এলজিবিটি কম্যুনিটি এতবড় ট্যাবু। ওরা আমাদের মতো নয়! ওরা আমাদের কথামতো চলে না! এই আনুগত্যের দাবী আমাদের প্রাচ্য সমাজ থেকে দূর করা প্রায় অসম্ভব কাজ। অতি শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত লোকজনই পেরে ওঠেন না, তো খাপ!
মানুষ করার মূল্য ফেরত চাওয়া। সন্তান আমাদের দেশে বুড়ো বয়সের লাঠির সমান। শতকরা নিরানব্বই ভাগ মা বাবা সন্তান জন্ম দেন বা বিয়ে করেন দুটিই কারণে। এক, বুড়ো বয়সে কে দেখবে? দুই, বংশ থাকবে না। শুনতে অতি খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। এই দুই কারণ বিশেষ করে মেয়েদেরকে ছেলেদের তুলনায় দ্বিতীয় সারিতে বসিয়ে দেয়। আমার মায়ের পুত্রসন্তানের লোভকে আমি ক্ষমা করে দিই কারণ তাকে সমাজ এই-ই শিখিয়েছে। আমি মেয়ে, আমার বিয়ে হবে, গোত্রান্তর হবে। আটাশ বছর বয়সে হঠাৎ একদিন রাতে, আলো ঝলমলে রাতে, আমার শরীরের মননের প্রতিটি কণা অটুট থাকলেও আমার পরিবার আর গোত্র পালটে যাবে। আমি দান হয়ে যাবো অন্য কোনো পরিবারের কাছে। আমি আর আমার মায়ের পরিবারের লোক থাকবো না। আমার বাবা মাকে দেখার সম্ভাবনা নির্ধারিত হবে অন্য পরিবারের দয়ার ওপর। এই পরিস্থিতিতে কন্যা সন্তান কে কামনা করে? যাদের এই সিস্টেম টিকিয়ে রাখার দায় আছে, তারা তো মোটেই না। পুত্র মুখাগ্নি এবং পিণ্ডদানের অধিকারী, কন্যা নয়। মুখাগ্নি এবং পিণ্ডদান ব্যতীত পুৎ নামক নরক থেকে উদ্ধার মেলে না।
এই সরকার কিছু করবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ এই সরকার, এবং তার আগের ও পরের সব সরকার, এই সমাজেরই অংশ। মোদী তার বউকে তাড়িয়েছে, কিন্তু মায়ের সাথে নিয়মিত দেখা করতে যায়। এই ছবি এবং ক্লিপ আমাদের মিডিয়া নিয়ম করে দেখায়। সোনিয়া মাইনো কী সুন্দরভাবে মিশে গেছেন আমাদের ভারতীয় সমাজে! মাথায় আধঘোমটা অবধি করেন। রাহুল গান্ধী যতই অযোগ্য হোন, তিনিই দলের মুখ হবেন, প্রিয়াংকা না। এই সমাজ আর পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে কারোর রেহাই নেই। এই ভয়ংকর "আমার মত হও, প্রজন্মান্তরে হতে থাকো" বাদের হাত থেকে কারোর রেহাই নেই।
আমি বরং ব্যক্তির ক্ষমতায় আস্থা রাখি। যে পিআইএল নিয়ে এত হইচই, তা করেছিলেন মহিলা সংগঠন শক্তিবাহিনী। তারা উত্তর পশ্চিম ভারত সহ দেশের বহুজায়গায় মাঠে ঘাটে নেমে কাজ করা গ্রুপ। মনোজ আর বাবলির 'অনার কিলিং' মনে আছে? সেশন কোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট, খুনের চেষ্টা থেকে সামাজিক বয়কট অবধি সব লড়াই-ই মনোজের মা এবং বোন একা হাতে লড়েছেন, লড়ছেন। তারা ক্যমেরার সামনে এসে কখনো বলতে ভয় পাননি, নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করা কোনো অপরাধ না। আমাদের বাচ্চারা কোনো অন্যায় করে নি।
পৃথিবীতে যতদিন স্বার্থপর পরিবার, সমাজ, ধর্ম এবং ইজম থাকবে, ততদিন মায়েরা পুত্রলাভের আশায় জলপড়া খাবেন এবং খাপ নিশ্চিন্তে "অবাধ্য মেয়ে হলে মেয়েই জন্ম দেবো না" বলতে থাকবে। সরকার এই বৃহত্তর প্যাটার্নেরই অংশ। সুতরাং তারা চোখ বুজে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আশার কথা শুধু এই সামান্য সংখ্যক অবাধ্য ছেলেমেয়ে। এরা, যারা কোনোভাবে ফাঁক গলে জন্মে গেছে বা যাবে।
এদের হাত ধরেই একদিন পৃথিবীর মুক্তি হবে।
লেখক: প্রকৌশলী