তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই

প্রকাশ | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২০:৪৯

নিমন্ত্রণে যেও না। বন্ধুর জন্মদিন হলে তো অবশ্যই না। সমাজ থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে জননী। তুমি যাকে ভালোবাসো সে হয়তো ঠিক তোমাকে নয়, অন্য কিছু পেতে ব্যাকুল। ভালোবেসে তুমি নিঃস্ব হতে চাও, কিন্তু প্রতারক তোমার বিশ্বাসের মূল্য দিতে সম্মত নয়। বনানীর একটি অভিজাত আবাসিক হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিলো। সেই বিচার এখনো পাওয়া যায়নি! কালক্ষেপণের ফাঁদে ন্যায় বিচারের আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। বনানীর ন্যাম ফ্ল্যটের পর আবারো একটি আবাসিক হোটেলে হয়েছে পুনরাবৃত্তি।

খুলনায় একজন কিশোরী, মাত্র ১৪ বছর বয়স। ক্রিকেট খেলায় তার সুনাম আছে এলাকায়, প্রায়শই এখানে সেখানে খেলতেও যায়। অসাধারন নৈপুণ্য দেখিয়ে বেশ কিছু কাপ ও মেডেল সে পেয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী সবাই তাকে উৎসাহ দেয়। মা নেই মেয়েটির, বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা ভাবতেন তার মেয়ে হবে একদিন সালমা কিংবা জাহানারা, দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করবে। মামা ও ভাই ডাকে এমন দুই প্রতিবেশী তাকে খেলতে যাবার কথা বলে নিয়ে যায় শহর থেকে একটু দূরের চিংড়ি ঘেরে। সেখানে আরো একজন যুক্ত হলে মেয়েটিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি রেখে ধর্ষণ করে। ভয়ে বলতে পারেনি সে কথা, এখন সে তিন মাসের গর্ভধারিণী।

একজন প্রতিষ্ঠিত সুরকার ঘরে তারকা স্ত্রী ও সন্তান রেখে সঙ্গীতের একজন ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে অস্বীকার করলে মেয়েটি আইনের আশ্রয় নেয়। সুরকার জেলে যায়, স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দেয়, কিন্তু তার মুক্তি মেলে না মামলার কারণে। বিয়ের রফা হয়, মুক্তি পায় কিন্তু সংসার হয়নি ভুক্তভোগী মেয়েটির।

জাতীয় ক্রিকেট দলের এক তরুণ খেলোয়ারের প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা ও ধর্ষণের মামলা করেন একজন চলচ্চিত্র নায়িকা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মেয়েটি সবার কাছে সমাদৃত হয়নি। বিশ্বকাপ সামনে রেখে তখন তারকা খ্যাতি কাজে লাগিয়ে ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিলো। এর পর আরো দুইজন ক্রিকেটার বেশ কয়েক মাস জেল খেটেছেন প্রায় একই ঘটনায়।

ফেসবুকে পরিচয়, সেই সুবাদে আলাপ, বন্ধুত্ব। তারপর দেখা করার বাহানায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এতো সব রটনা, তবুও আমরা সজাগ হচ্ছি না কেন? কাকে বিশ্বাস করবো আর কার প্রতি রাখবো আস্থা? জটিল সমীকরণে আমরা হয়ে উঠবো আরো অসামাজিক, এটা নিশ্চিত।

কিছুদিন আগে দেখলাম অভিনব এক ঘটনা। বাচ্চা একটা শিশুর হাতে ঠিকানা লেখে কাগজ ধরিয়ে গলির রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হলো। কোন তরুণীর যদি এতে মাতৃত্ব বোধ জাগ্রত হয় এবং শিশুটিকে হাতে গুজে দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে দিতে যান, তবেই ঘটে বিপত্তি। নাজেহাল এবং লাঞ্ছিত হতে হয়। এভাবেই মনবতাশূন্য হবে সমাজ?

ভারতের মহামান্য হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন বিয়ের প্রলোভন দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। আর ধর্ষণের পর আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারেই। ধর্ষণ একটি দুর্ঘটনা হলেও এর শিকার হতে পারে যে কেউ। অপমানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অকালে ঝড়েছে অগণিত প্রাণ। এই মৃত্যু অপ্রত্যাশিত, অপূরণীয় ক্ষতি।

আমরা যখন খুব ছোট, তখন দেখতাম মেয়ে বাড়ির বাইরে গেলে মায়েরা সাথে ছোট ভাই কিংবা ছোট বোন দিয়ে পাঠাতেন। এখন বুঝি এর কারন ছিলো একটা বাড়তি সতর্কতা। সময় এখন একাকিত্ব্যের, কেউ কাউকে শেয়ার করে না কিছুই। সামজিক মানুষ আমরা, বিশ্বাস তো রাখতেই হবে কারো না কারোর প্রতি। কিন্তু এই যে বিশ্বাসের প্রতি অমর্যাদার মহামারি শুরু হলো, এর পরিনাম কিন্তু ভয়াবহ।

রাঙামাটি শহরে সম্প্রতি তিন কিশোর ১৩ বছরের এক কিশোরীকে প্রথমে ধর্ষণ করে এবং সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারন করে রাখে। এর পর তারা বার বার মেয়েটিকে অত্যাচার করে ও ভিডিও ধারন করে রাখতে থাকে। খবরে প্রকাশ তাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে এবং তারা আমতলি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও এসএসসি পরীক্ষার্থী। মামলা হয়েছে এবং আদালতে এই কিশোরের দল ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সত্যতা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে কিছু খুঁত কিংবা ফাঁক ফোঁকর আছে নিশ্চয়ই, যা খুঁজে বের করা জরুরী। আর এতো বেশি সময় দেয়ার যৌক্তিকতা কি? প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত বিচার করা হোক। ধর্ষক কিশোর তরুণ হলেও বয়সের কারনে অনুকম্পা পাবে কেন? বন্ধু সেজে, ডেকে নিয়ে ধর্ষণ আর মানুষ খুনের মধ্যে পার্থক্য কি?

মা গো, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই।

লেখক: উন্নয়নকর্মী