ধর্ম নয়, ভালোবাসাই বাঁচিয়ে রাখে সভ্যতাকে
প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:২৬
ভারতবর্ষের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক, বর্ণবিদ্বেষী, জাতিবিদ্বেষী দেশে জন্মালে ধর্ম, জাত, বর্ণ, গোত্র দেখে তবেই ভালোবাসতে হয়। প্রেম করতে হয়। বিয়ে করতে হয়। এর অন্যথা হলে আমাদের সমাজের তথাকথিত ধর্মের পতাকাধারীরা তা মেনে নেন না, এটা ভুলে যাওয়া অঙ্কিতের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিলো।
যতই আমাদের সংবিধানে লেখা থাক প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর যে কোনো ছেলে বা মেয়ে যে কোনো ধর্মের, জাতের, গোত্রের কাউকে বিয়ে করতে পারে; প্রত্যেকটি মানুষের নিজের পছন্দের মানুষ নির্বাচনের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং তাতে ধর্মের, রাষ্ট্রের, সমাজের মাথা গলানোর কোনো অধিকার নেই। যতই স্পেশাল ম্যারেজ এক্টের ব্যবস্থা থাকুক দেশের আইনে, যতই সুপ্রীম কোর্ট রায় দিক, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করলেও কোনো মেয়েকে যে ধর্ম বদলাতে হবেই এর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সে তার নিজের ধর্ম চর্চা করতে পারে - আমাদের দেশের ধর্মান্ধ নারী-পুরুষ তা মানতে বা বুঝতে চান না।
মুসলমান হয়ে হিন্দু ছেলেকে ভালোবাসবে!! হিন্দু হয়ে মুসলমান ছেলের সাথে প্রেম করবে!! ধর্ম নষ্ট করবে আমাদের? পরিবারের সম্মান নষ্ট করবে? লাভ জেহাদ করবে? মারো শালাদের, খুন করে ফেলো পিটিয়ে। জ্যান্ত জ্বালিয়ে বার্তা দেও সমাজে, ভিন ধর্মীকে ভালোবাসলে এই অবস্থা হবে। মিথ্যে ঘটনা, ফটোশফড ছবি দিয়ে প্রচার চালাও মানুষে মানুষে ভালোবাসা, প্রেম আসলে লাভজেহাদ।
এবং বাকি সব বিষয়ে এরা একে অন্যের শত্রু হলেও এই একটা ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের খুব মিল। হিন্দু সমাজও মুসলমান কারোর সাথে প্রেম, বিয়ে মেনে নেয় না, মুসলমান সমাজ ও হিন্দু কারোর সাথে প্রেম, বিয়ে মেনে নেয় না। যদি দৈবাৎ কোনো ছেলে-মেয়ে তাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিয়ে করেও নেয়, সেক্ষেত্রে হয় ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে খুন করা হয়, রাস্তাঘাটে হিউমিলিয়েট করা হয়, সমাজে একঘরে করে রাখা হয়; নতুবা ছেলে বা মেয়েটিকে কোনো একটি বিশেষ ধর্ম বেছে নিতে হয়! আর এইক্ষেত্রে প্যান্ট-শার্ট পরা ভদ্রলোক থেকে নিম্নশ্রেণীর অশিক্ষিত- সব সমান।
অতীত থেকে আজ অব্দি, শুধু ধর্মের কারণে যত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর কোনো কারণে বোধহয় ততো হত্যা হয়নি। ধর্ম দেশভাগ করিয়েছে, মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করিয়েছে, জাতি দাঙ্গা করিয়েছে, মানুষ খুন করিয়েছে, যুদ্ধ করিয়েছে, হাজার নারীপুরুষকে ভেলায় চাপিয়ে মাঝ সমুদ্রে অজানার উদ্দেশ্যে ভাসিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসায় মানুষের হাত স্পর্শ করেনি কখনো।
মানুষ কোনোদিন বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়নি ভালোবাসার মতো অপূর্ব সুন্দর জায়গা আর কোথাও নেই, কোনোদিন ছিলো না। ধর্ম যতবার মানুষকে রক্তাক্ত করেছে, বলি দিয়েছে, জবেহ করেছে, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লড়িয়েছে, যুদ্ধ করিয়েছে, ধর্ষণ করিয়েছে, ততবার ভালোবাসা এসে তার স্পর্শ রেখেছে বলেই এখনো সভ্যতা টিকে আছে। ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এত রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পরও।
পৃথিবীর যত ভালো কিছু আছে, যত শিল্প আছে, যত প্রেমের দর্শন আছে, যত সৌন্দর্য আছে তাতে কিন্তু ধর্ম অথবা তার এজেন্ট মোল্লা, পুরোহিত, পাদ্রী কারোর হাত নেই, ভালোবাসার হাত আছে। তাই যুদ্ধে শত শত মানুষ খুন করা মোঘল সম্রাটকেও প্রেমের কাছে মাথা নত করে প্রেমের সৌধ নির্মাণ করতে হয়েছে। ভালোবাসা যদি না থাকতো ধর্মের কারাগারে আটক থাকতে থাকতে মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতো। একে অন্যের মাংস ছিঁড়ে খেতো!
ধর্ম ত্রিশুল আর চাপাতি ধরা ছাড়া আর কিচ্ছু শেখায়নি এটা মানুষ বুঝতে পারে না। আর পারে না বলেই ভালোবাসাকে নির্মমভাবে হত্যা করে ধর্মের জন্যে। লালন সাঁই বলেছিলেন,
“এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে…”
এই উপমহাদেশের মানুষ সত্যি যদি এই কথাটা বুঝতো, তাহলে হয়তো আর কোনো অঙ্কিতকে ভালোবাসার জন্যে খুন হতে হতো না, আর কোনো আফরাজুলকে লাভ জেহাদের নামে খুন হতে হতো না। আর কোনো ছেলে বা মেয়েকে ধর্ম, সমাজের ভয়ে নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে যেতে হতো না!
লেখক: শিক্ষক