শিশুদের জন্য ভাবতেই হবে
প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:১২
শিশু: মা, মিস বলেছে এই ডাইরিটা দেখতে
মা: তোমার বাবাকে বল
শিশু: মিস তো তোমাকে দেখতে বলেছে মা…
মা: বললাম তো বাবাকে দেখতে বলো…
মা ব্যস্ত ছিলেন রান্নাঘরে, তিনি সঙ্গত কারনেই বলেছেন স্কুলের ডাইরিটা যেন বাবাকে দেখানো হয়। শিশুটি কি এখান থেকে ভুল বার্তা পাবে? হয়তো, কারন সে দ্বিতীয়বার বলেছে যে এই ডাইরিটা মাকে দেখাতে তার মিস বলেছে। মনে হয় স্কুল থেকে তার শিক্ষিকা বলেছেন এই ডাইরিটা মাকে দেখাতে, বাবাকে না দেখাতে বলেনি যদিও। শিশুটি তাই মাকেই দেখতে বলেছে। এখানে শিশুটি সঠিক কাজই করেছে। মা ব্যস্ততায় যে উত্তর দিয়েছেন তাতে শিশুটি ভুল বার্তা পেতে পারে। ঘটনা হয়তো সামান্য, আমি ভাবছি শিশুটি কি বিভ্রান্ত হচ্ছে?
সমাজকর্ম অধ্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে মাঠকর্ম বা ফিল্ডওয়ার্ক। অনেকেই এটাকে হালকা মেজাজেই হ্যান্ডল করেন। কোন মতে বেড়িয়ে আসতে পারলেই হলো! যাই হোক, অনার্সে আমি কাজ করেছি পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের নিয়ে। একটা ছেলের কথা এখনো আমার মনে আছে। ছেলেটি হোটেল বয় ছিলো। অসাধারণ তার গানের গলা, শ্যাম বর্ণের ছেলেটির ঠোঁট ছিলো ধূমপায়ীদের মতোই কালো। তার সাথে আমি কর্মস্থলে গিয়েছি, কোথায় থাকে দেখেছি এমনকি মালিক ও সহকর্মীদের সাথেও কথা বলেছি। জানলাম যে নিয়মিত সিগারেট খায়। ছেলেটির বয়স তখন ১২ কিংবা ১৩, এর বেশি হতেই পারে না।
আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম, একদিন তাকে একটা সিগারেট দিলাম, বললাম খাও। বেচারা খুব লজ্জা পাচ্ছিলো, আমাকে খুব ভালোবাসতো, কেঁদেই ফেললো। আমার জন্য সে প্রায় প্রতিদিন একটা করে ফুল নিয়ে আসতো। মোদ্দা কথা হলো, হোটেলে বসে অনেক কাস্টমার বিড়ি সিগারেট খেয়ে থাকেন। তারা সেসময় সিগারেট ও ম্যাচ কিংবা আগুন বয় বেয়ারার কাজ করা বাচ্চাদের দিয়েও আনিয়ে থাকেন। আবার ধূমপান শেষে অনেকেই অবশিষ্ট অংশ ছুঁড়ে ফেলেও দেন যেখানে সেখানে। এই শিশুটি সেই কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেট থেকেই আসক্ত হয়ে উঠেছে। এর দায় কি আমরা নেব না?
সম্প্রতি যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতার একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একটি বাচ্চা ছেলে মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছে, যা রক্তাক্ত, চোখের নিচে কালশীটে দাগ। বুকে প্ল্যাকার্ড: “বউ এর সাথে তর্ক করেছিলাম”। ঘরে বাইরে যেখানে নারী নির্যাতনের নানা ঘটনা আমাদের শংকিত ও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে, সেখানে কৌতুক করে এই রকমের প্রদর্শন কি খুব প্রয়োজন ছিলো? হয়তো কোথাও কোথাও স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের হাতে লাঞ্ছিত কিংবা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কিছুদিন আগে প্রেসক্লাবের সামনে এই নিয়ে মানব বন্ধন হতেও দেখেছি। কিন্তু কথা হলো এমন একটা বিষয় শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মানে কি? তারা কি বার্তা পাবে? এই ছবি দেখে তার বন্ধু সহপাঠীরা যদি এটা শিখে যে, বাসায় বাবা মায়েরা মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে দেয়... সেটা কি ঠিক হবে? বড় হয়ে তারাও কি সহিংসতায় মেতে উঠবে?
এমনই সামান্য অনেক ঘটনা থেকে শিশুর মনে একটু একটু করে ভুল বার্তা যুক্ত হতে থাকে। তখন সে পথ হারিয়ে ফেললে অবাক হচ্ছি আমরা। তবে তাদের সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য বিশেষ কিছু করছি বলেও মনে হয় না।
আসলে আমরা যেভাবে বড় হয়েছি কিংবা আমার বাবা মায়েরা যেভাবে বড় হয়েছেন, আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেটা হয়তো সম্ভব হবে না। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবারের জয় জয়কার এখন। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে মায়েরাও পিছিয়ে নেই। শিশুরা এমনিতেই বাবা মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিন থেকে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চাকেও এখন স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগের ওজন কতটুকু হলে তার মেরুদণ্ড শক্ত হতে পারে সেই গবেষণা এখনো চলছেই। স্কুল, কোচিং এর ফাঁদে শিশুদের শৈশব চুরি হয়ে গেছে সেই কবে।
সামাজিকীকরণের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে পরিবার। মা বাবা, ভাই বোন এই ক্ষেত্রে এক একজন শিক্ষক প্রতিটি শিশুর কছে। পরিবারের পর প্রতিবেশী তারপর স্কুল সর্বত্রই শিশুরা শিক্ষা গ্রহণ করে। নতুন কিছু জানতে পারাকেই আমি এখানে শিক্ষা বলছি। ধর্মীয় উপাসনালয় এমনকি বিয়ে জন্মদিনের কমিউনিটি হলেও বাচ্চারা শিক্ষা নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার শিশুদের জন্য কোন চলচ্চিত্র উপযুক্ত নয় সেটা কিন্তু অনুমোদন দেয়ার সময়েও উল্লেখ করে দিতে হয়। অর্থাৎ শিশুদের সামনে সব কিছু করা যাবে না।
বাচ্চাদের গ্যাং কালচারে ইতিমধ্যেই রক্তাক্ত হয়েছে কৈশোর। বন্ধুদের হাতে প্রাণ গেছে ঢাকা, চিটাগাং, খুলনায় এই কিছুদিন আগে। শিশুরা বিশেষ করে পথশিশুরা ব্যাপক মাত্রায় মাদকে আসক্ত হচ্ছে, এর দায় কোন ভাবেই আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। সমাজের একটি অংশ বিপথগামী হলেও এর প্রভাব গোটা সমাজের উপর আসবেই।
বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, অবসর নেই বাবা মায়ের। বিয়ে করেছি, বাচ্চা হয়েছে। বাবা মা যেভাবে মানুষ করেছে, কিংবা যেভাবে যৌক্তিক মনে হয় আমরাও সেভাবেই মানুষ করার চেষ্টা করছি আমাদের সন্তানদের। সন্তান লালন পালনের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বাবা মায়ের। এমন কোন কোচিং সেন্টার আছে কি না আমার জানা নেই, যেখানে বাবা মায়েদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে বিষয়টা জরুরী।
অনেক অনলাইন পোর্টাল কিংবা ওয়েবসাইট আছে এই সংক্রান্ত, অনেক ভালো ও তথ্যে সমৃদ্ধ। কত কিছু তো জানি না। হিউম্যান সাইকোলজি ভীষণ জটিল বিষয়, আর শিশুদের জন্য তো আরো কঠিন। ওদের সাথে কথা বলা, বিশেষত কমিউনিকেশন, এটা সবাই পারে না। একজন শিশুর অভিব্যাক্তি দেখেও অনেক কিছু বুঝতে হয়। একজন বাবা হিসেবে বলছি, আমি নিজেও জানতাম না অনেক কিছুই। এখনো জানি না, তাই প্রতিনিয়ত বোঝার চেষ্টা করি। বাচ্চাদের সাথে কথা বলি, জানার চেষ্টা করি।
আমরা যারা বাচ্চাদের থেকেও বড়, তাদের এই দায়টুকু নিতেই হবে। আমাদের পর্যবেক্ষণে থাকা তথ্য স্মৃতিতে ধরে রাখি, যা পরবর্তীতে বিকল হয়। আমরা যা করবো, যা বলবো, যা দেখাবো একটি বাচ্চা নতুন ভেবে তাই রপ্ত করে নেবে। তাই আমাদের যাবতীয় আচরণ হউক এই বিষয়টি মাথায় রেখেই। শিশুদের জন্য একটু ভাবতেই হবে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী