মেয়েদের অধিকার বনাম মেয়েদের সুযোগ
প্রকাশ | ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২২:৫৫ | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:৫৯
'নারীবাদ' এর সবচাইতে সহজবোধ্য সংজ্ঞা হচ্ছে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই যেন সবরকম অধিকার ভোগ করতে পারে; - যেমন, ভোটদান, লেখাপড়া, চাকরি, ইত্যাদি। আমাদের সমাজে এই 'অধিকার'গুলো সুপ্রতিষ্ঠিত, কোন আইন এমন নেই যে শুধু ছেলেরাই ভোট দিতে পারবে, মেয়েরা নয় (আমেরিকাতে যেমন ১৯২০ সালের আগে নারীরা ভোট দিতে পারতো না)।
কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই বুঝি হলো? অধিকারের হাতে হাত ধরে আসে যে শব্দটি, তার নাম 'সুযোগ'।
ভোটদানের কথাই বলি; নাগরিক হিসেবে আপনার অধিকার আছে তো অবশ্যই, কিন্তু সেইদিন যদি আপনাকে সারাদিন অফিস করতে হয়, আর অফিস ছুটি হতে হতে ভোট-কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আর লাভটা কি হলো? (আমেরিকাতে এই ব্যাপারটাও ঘটে খুব; এদেশে জাতীয় নির্বাচনের অফিশিয়াল দিনটি যেন সরকারী ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়, অনেকেই এই দাবী বহুদিন ধরে করছেন)। আপনার ভোটের অধিকার তো বৃথাই তাহলে, - পছন্দের প্রার্থীকে যদি ভোট দিতেই না পারলেন সুযোগের অভাবে!
এই জিনিসটিই এইবার একটু নারীবাদের আলোকে দেখি। সমাজের অনেক ভালোমানুষেরাও, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, (হতে পারে অজান্তেই) কেমন করে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন, সেটি একটু দেখি।
আমাদের সমাজেই বহু মানুষ আছেন, দুই সন্তানকে সুশিক্ষিত করবেন এই ব্রত তাদের আছে। বরং, যদি শোনেন কেউ কেবল ছেলেসন্তানকে স্কুলে পাঠান, মেয়েটিকে ঘরে রাখেন, তাহলে তারাই সবার আগে ধিক্কার দিয়ে উঠবেন। কিন্তু এই অধিকার-সচেতন মানুষগুলোর মধ্যে কি অনেকেই নেই, ছেলেটিকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে তারা প্রস্তুত, কিন্তু মেয়েটি যেতে চাইলেও দেবেন না, কিংবা, শর্ত জুড়ে দিবেন, - বিয়ের আগে নয়!
এই অধিকার-সচেতন মানুষগুলো মেয়েদের চাকরির ব্যাপারে বাধা দেবেন না, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত। কারো ক্ষেত্রে সেই সীমাটি বিয়ে (বিয়ের আগ পর্যন্ত চাকরি ভালো, তার পরে নয়); কারো ক্ষেত্রে সন্তান (সন্তান নেয়ার আগ পর্যন্ত চাকরি ভালো, তার পরে নয়); কারো ক্ষেত্রে হয়তো সেটা মেয়েটির স্বামীর আর্থিক অবস্থান (যতক্ষণ তোমার বেতন স্বামীর চাইতে কম কিংবা সমান সমান, ঠিকই আছে, কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে গেলে নয়)!
বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি এই আমেরিকাতে বসেই এমন ঘটনা দেখেছি, যেখানে মেয়েটিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে শহরের বাইরে পড়তে যেতে (যদি কিছু উল্টোপাল্টা হয়ে যায়!)। আর বিবাহিতা নারীকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে, প্রমোশনটি না নিতে বা উচ্চতর ডিগ্রীটি না নিতে (তোমার স্বামীর মন খারাপ হতে পারে, সংসার ভালো রাখতে তার ইগোর দিকটা তোমার চিন্তা করা উচিত!)।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের অন্যতম সমস্যাটাই হচ্ছে, ছেলেদের কিছু বাড়তি সুযোগসুবিধা দেয়া, আর মেয়েদের বঞ্চিত করে রাখা। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষই এখনো এই ভাবনাটাকে 'অধিকারে' সীমাবদ্ধ করে রাখি: "আমার পক্ষ থেকে আমি আমার জীবনের নারীদের তাদের মৌলিক অধিকারের ব্যাপারটা নিশ্চিত করছি, অতএব, আমি ঠিক আছি, - আমি কারো ক্ষতি করছি না। আমাকে কেউ পুরুষতান্ত্রিক ভাবতেই পারবে না, না, না, না! আমি নারীবাদ শব্দটা ব্যবহার করি আর না করি, আমি নারীদের সমান অধিকারে বিশ্বাস রাখি - অতএব, আমি ঠিক আছি, ঠিক আছি, ঠিক আছি!"
কিন্তু না, কেবল মাত্র অধিকার যথেষ্ঠ নয়; সুযোগ-বিনা সে অধিকার যে মূল্যহীন!
আপনি ক্ষমতাসীন কোন পদে না থাকতে পারেন, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষমতা আপনার হাতেও আছে।
আপনার কন্যাসন্তানটি যদি উচ্চশিক্ষার জন্য শহরের বাইরে কি দেশের বাইরে যেতে চায়, তাকে সেই স্বপ্ন দেখার সুযোগটুকু দিন। আপনার বান্ধবী যদি প্রমোশনের কথা চিন্তা করে থাকে, তাহলে তাকে উৎসাহ দিন। আপনার স্ত্রীর আর্থিক অবস্থান যদি আপনার চাইতে ভালো হয়ে থাকে, তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই তো হয়েছে, নয় কি? সে অর্থ তো আপনাদের সংসারেরই সম্পদ, নয় কি? তাকে নিয়ে গর্ববোধ করুন, তাকে সাপোর্ট দিন তার ক্যারিয়ারে, পারস্পারিক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাই তো সংসারের ভিত্তি, নয় কি?
আমি আগে ভাবতাম পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের মানুষেরা বুঝি "ছেলেরা তো এমনই হয়", "পুরুষমানুষরা তো একটু আধটু এমনটা করবেই", "মেন্ উইল বি মেন্/বয়েজ উইল বি বয়েজ" এরকম কথাবার্তা সরাসরিই বলে দেয়। না, কেউ আসলে এভাবে বলে না, আর হতে পারে এই কারণেই নিজেদের মনোভাবকে সমস্যাজনক বলে চিহ্নিতও করতে পারে না। আপনার নিজের বেলায় বরং আপনি নিজের জন্য একটা মাপকাঠি তৈরী করে নিন। আপনি যেখানেই দেখবেন, নিজের বেলায় হোক বা অন্যের বেলায়, খুব ছোট্ট কিছুতেও ছেলে বনাম মেয়েকে দুই ভাগে ভাগ করছেন, সেটি আগে মনের মাঝে ঝালাই করে নিন -এর প্রয়োজন কি আদৌ আছে? আমি কি অন্যভাবে একটু করতে পারি/বলতে পারি একই জিনিস যা আরো সমতা আনতে পারে? যদি সে সুযোগ থাকে, তবে সেটিই করুন।
আমার পরিচিত এক দম্পতি, ছোট্ট সন্তান আছে তাদের, দুজনেই চাকরি করেন। ঘরের কাজ খুব সুন্দর করে দুজনে ভাগ করে নিয়েছেন; দুজনেই মিলে মিশে রান্না করেন, ঘর পরিষ্কার করেন, বাচ্চা সামলান, কোন একজনের একার দায়ভার বলে কিছু নেই সে সংসারে। আমার এক বিবাহিত বান্ধবীকে যেদিন স্বামীর ইগোর কথা ভেবে নিরুৎসাহিত করা হলো, সে তাদের কথায় কান না দিয়ে তার স্বামীর সাথে বসেই আলোচনা করে নিলো, তার প্রমোশনের পাশাপাশি তার যে বাড়তি কাজ বেড়ে যাবে, সেটি সংসারে কোন প্রভাব ফেলবে কিনা, আর ফেললেও কিভাবে তারা সামাল দেবে। কোন ইগো নেই কারোরই, স্রেফ প্র্যাকটিকাল আলাপ; সাধ আর সাধ্যের সংমিশ্রণে সিদ্ধান্ত - যা স্বামীর প্রমোশনের বেলাতেও তারা করতো। এই অবিবাহিত আমাকে যদি কেউ বলে, "বিয়ে হয়েছে?" আমি বলি, "বিয়ে করিনি"। পুরুষরা যদি বিয়ে করে বা না করে, মেয়েদের বেলায় কেন এমন প্যাসিভ শব্দ ব্যবহৃত হবে, - আমার পক্ষ থেকে তাই এই ছোট্ট সমাজ-সংস্কার।
ছোট হোক, বড় হোক, - আপনার পক্ষ থেকে আপনিও শুরু করুন। অধিকার তো আছেই, সুযোগের ক্ষেত্রেও সবাই মিলে সচেতন হই; সমতা আজ হোক, কাল হোক, আসবেই!
লেখক: লেখক ও অ্যক্টিভিস্ট