রক্ষা পাক বাঙলা চলচ্চিত্র

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:১৪

কোরান নিয়ে যখন মুক্তমনারা সমালেচনা করেন তখন আস্তিক মুমিনগণ বলে থাকে - "আগে কোরানের একটা আয়াতের মত আয়াত লেখার মত ক্ষমতা অর্জন করুন, তারপর কোরান নিয়ে সমালোচনা করবেন"। এমনই সুর আজকাল কিছু সিনেমা সংশ্লিষ্ট জনতার কণ্ঠ থেকে বের হয়, "আগে একটা এমন (অমুক-তমুক সিনেমাকে উদ্দেশ্য করে) সিনেমার মত সিনেমা বানিয়ে দেখান, তারপর সমালোচনা করেন"। 

কোন কিছু নিয়ে সমালোচনা করতে, বিরোধিতা করতে সে কাজ করতে হবে, এমন কোন আয়াত, সুরা কি নাজিল হয়েছে? আমি জানি না, আপনারা জানলে আমাকে জানাবেন অনুগ্রহ করে। তাহলে আমি একটা সিনেমা বানানোর কাজ হাতে নিবো এবং একটা সিনেমা বানিয়ে সমালোচনা করবো - বাঙলাদেশের পরিচালক প্রযোজকগণ অধিকাংশই এক একটা ভণ্ড। যারা চলচ্চিত্র শিল্পকে বিক্রি করে নিজেদের পকেট গরম করে। শুধু তাই-ই নয়। চলচ্চিত্র জগতটাকে কলুষিত করতে বিছানা গরম করার বদলে অভিনেতাদের (পড়ুন স্টার হতে চাওয়া ধান্ধাবাজ) দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পকে গণধর্ষণ করাচ্ছে।

কয়েক দিন আগে পরিচালক কাজী হায়াত বলেছেন - এদেশের চলচ্চিত্রের এ ভঙ্গুর দশার জন্য নাকি ধর্ম দায়ী! অবশ্য তার কথা খানিকটা সত্য। কেন খানিকটা সত্য! কারণ পাকিস্তানের মত একটা জঙ্গীবাদী রাষ্ট্র আমাদের দেশের চলচ্চিত্র থেকে হাজার হাজার গুণ এগিয়ে। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই যখন দেখি পাকিস্তানি পরিচালকগণ ধর্ম, আল্লাহ, ভগবান, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সিনেমা বানায়, যেখানে আমাদের দেশে ধর্ম, আল্লাহ দূরে থাক জনগণের গোলাম রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দু/চারটা সংলাপ দিলেই সেন্সর বোর্ড সিনেমা আটকে দেয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে সিনেমা নিষিদ্ধের নীতিমালা তৈরী হয়। যেখানে পাকিস্তানের মত একটা জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী রাষ্ট্রে ধর্মকে, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ করে সিনেমা নির্মিত হয়, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সেখানে ধর্মীয় দিক থেকে আমরা তো নস্যি!

আমাদের ব্যর্থতা ঠিক কোথায়! আমরা জানি ঠিক কোথায়, কিন্তু তা আমরা স্বীকার করতে চাই না। কোন ধর্মীয় কারণ সিনেমার এ ভঙ্গুর দশার জন্য দায়ী নয়। সিনেমায় অপরিপক্ক অভিনেতাদের আগমন, যোগ্য অভিনেতাদের সুযোগ না দিয়ে এক রাত বিছানায় কাটালে কিংবা লাখ খানেক টাকার বিনিময়ে আনকোরা জনতাও অভিনয়ের সুযোগ পাচ্ছে। যার ফলে জগাখিচুরি হচ্ছে সব। আর বড় কারণ যেটা তা হলো, গঁৎবাধা প্রেম কাহিনী থেকে আমরা বের হতে পারি না। 

যেমন বাঙলাদেশের প্রতিটা সিনেমার শুরু হয় নায়ক নায়িকাকে কোথাও দেখে। তারপর ভাল লাগা, দুজনের পরিচয় হওয়া, হুট করে প্রেম হয়ে যাওয়া, এক পর্যায়ে কোন কারণে বিচ্ছেদ, কান্না, বিরহ এবং শেষে এসে প্রণয়। এদেশের শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ সিনেমার কাহিনীই এমন, মিলিয়ে দেখবেন। কিন্তু কেন? এসব প্রেম কাহিনীর বাইরে কি কোন কাহিনী নেই? সমাজের রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় সন্ত্রাস কিংবা জনগণের বাস্তব জীবনচিত্র নিয়ে কি সিনেমা তৈরী করা যায় না? বলবেন, ধর্ম নিয়ে বলতে গেলেই তো সেন্সর আটকে দিবে! কেন সে সুযোগ দিবেন? আন্দোলন করুন! ভারতীয় (কোলকাতা) সিনেমা এদেশে বাতিল করার জন্য না খেয়ে না নেয়ে দিনরাত তো আন্দোলন করতে পারেন। এর জন্য পারেন না?

গলদটা সমাধান না করে ধর্মের কাঁধে নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দায়সারা হতে চেয়ে কি প্রমাণ করছেন? আপনার হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা? তাহলে অযথা সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কোন প্রয়োজন আপনার আছে বলে মনে করি না। আপনার উচিত দাড়ি রেখে, টুপি-পাঞ্জাবি পরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আর জ্বি হুজুর! জ্বি হুজুর! করে রাজনৈতিক নেতাদের পা চেটে জিহ্বা ভারী করা। সিনেমা আপনার জন্য না।

কাজী হায়াতের কথার প্রেক্ষিতে একটা কথা মনে হয়েছিলো, উনি যেভাবে সিনেমার ভঙ্গুর দশার জন্য ধর্মকে দায়ী করে দায় সারলেন তাতে করে উনি বোধহয় বুঝাতে চাইলেন উনি ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সিনেমা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা বানানোর পক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু উনার নির্মিত কোন একটা সিনেমা দেখলাম না যার মান সুস্থ। এমন কি কোন পরিচালক যদি ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে সিনেমা নির্মান করেনও আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সে সিনেমার বিরুদ্ধে হওয়া প্রতিবাদে কাজী হায়াত সম্মুখেই থাকবেন।

এ সকল কাজী হায়াত সমূহগণ নিজেদের ব্যর্থতা, কামড়া-কামড়া, খামচা-খামচিকে কোনভাবে নিজেদের মূর্খতার কারণ হিসেবে দেখে না। বরং এরা ধর্মকে দায় দিয়ে নিজেদের নষ্ট সময়কে বৈধতা দিয়ে সিনেমাকে মেরে ফেলার পাঁয়তারা করে চলেছেন। এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে সিনেমাকে রক্ষা করতে। সেক্যুলার, প্রগতিশীল তরুণ প্রজন্ম সিনেমার হাল ধরুক এই কামনাই করি। বাঙলা সিনেমা এগিয়ে যাক। বিশ্ব জয় করুক। সুবিধাবাদী, ভণ্ডদের হাত থেকে রক্ষা পাক চলচ্চিত্র শিল্প।

লেখক: অভিনেতা ও সংস্কৃতি কর্মী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত