অপেক্ষা শুধুই কড়া নাড়ার
প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৩৬ | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৫৪
বেশ কিছুদিন ধরেই একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। আজ লিখেই ফেলি। একটু আগে মহীতোষ মন্ডলের একটা লেখা পড়লাম, ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা পদবী-জাত-বর্ণ নিয়ে আদিখ্যেতার কাহিনী। পড়তে পড়তে বারবার নিজের কথা ভাবছিলাম। আমার নাম কেউ প্রথমবার শুনলে বা প্রথম কারো সাথে পরিচয় হলেই মানুষ খানিকটা ঘেঁটে যায় লক্ষ্য করেছি আমি সেই ছোটবেলা থেকেই। আসলে বুঝে উঠতে পারে না মাথার ভেতর ঠিক কোন ঘরটায় বসাবে আমাকে। হিন্দু না মুসলমান আঁচ করতে পারে না। বাঙালি না গুজরাটি না পাঞ্জাবী তাও বোঝার জো নেই। জাতের কথা তো বাদই দিলাম।
ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ক্লাসে নাম ডাকার সময় ঠিক যেখানটায় এসে শিক্ষক বা শিক্ষিকা দু'মিনিট ভিরমি খাবেন, সেই মুহুর্তে 'প্রেজেন্ট' বলে ওঠায়। 'শবনম সুরিতা' কীভাবে শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ও জয়িতা নন্দী মজুমদারের মেয়ে হতে পারে তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে কর্মরত মানুষদের অবাক হবারও কোন সীমা ছিল না। সারাটা জীবন আমার পরিবারের একাংশ বাবা-মাকে খোঁটা দিয়ে কথা শুনিয়ে গেল (এবং আজও বহালতবিয়তে করে চলে) ঠিক কত রকমভাবে আমার নামকরণ আমাদের পরিবারের "সু"-নামের বিপরীতধর্মী (যদিও আমার জানা মতে আমাদের সিলেটের পূর্বপুরুষেরা বেশ নামডাক ওয়ালা অত্যাচারী, স্বৈরাচারী জমিদার ছিলেন)।
যাদবপুরে পড়তে আসার পর সেখানের প্রগতিশীল, খোলা মনের অনেক লোকের সাথে আলাপ হল। তারাও প্রায়ই দেখতাম কেমন বিস্ময়ের সাথে খানিক সন্দেহ মিশিয়ে আমার দিকে তাকাতেন যখনই বাংলা বলতাম। একবার তো ক্লাসের এক শিক্ষকের সাথে লেগেই গেলো ধুন্ধমার কান্ড! ঘর ভর্তি বন্ধু-বান্ধবদের সামনেই বারবার টেনে আনতে লাগলেন আমি আসামের মেয়ে, আজব একটা নাম, বারবার বাংলাদেশে যাই, হাব-ভাব ব্যবহারের সাথে খাপ না-খাওয়া বামপন্থী রাজনীতি করি এই সমস্ত অহেতুক কথাবার্তা। সেই সেমেস্টারে তারপর ওই শিক্ষকের একটাও ক্লাস করিনি।
মা-বাবা ভেবেছিল মেয়ের পদবী তুলে দিয়ে আমার জীবনযাত্রা মসৃণ করে তুলবে। ভেবেছিল, এমন হলে সমাজ-রাষ্ট্র বারবার জানতে চাইবে না আমি কে। বাঁধতে চাইবে না আমায় ছোট ছোট পুরনো, ক্ষয়ে যাওয়া দড়িতে। আমি হিন্দু, না মুসলমান, বিবাহিত না বিধবা, তামিল না বিহারী কেউ যাতে না বোঝে। কাউকে যাতে আমার ঠিকুজী-কোষ্ঠী দিয়ে আমায় চিনতে, ভালোবাসতে, ঘেন্না করতে না হয়। কিন্ত তা আর হল কই? বরং এতে কৌতূহল বেড়ে দশগুণ।
আসলে মানুষ সব সময় আশেপাশে যা দেখে তাকে একটা নাম দিতে চায়, নিজের মত করে বুঝে নিতে চায়। এটা কী, কেন, কোথায় তার উৎপত্তি। যখনই ভাসমান কিছু দেখে, তাকে ডাঙায় না তোলা অবধি দু দন্ড শান্তি পায় না। রোহিত, চুনী বা মহীতোষবাবুকে নিয়ে আসলেই কোন সমস্যা হতো না। যদি বা রাষ্ট্র-সমাজ জায়গা করে দিতো তাদের ভেসে বেড়াবার জন্য।
এক একটা অচলায়তন বানিয়ে চলেছি আমরা নিজেদের চারপাশে হাজার হাজার বছর ধরে। জল-হাওয়া ছাড়া মানুষ থেকে ধৈর্যের সাথে গড়ে তুলেছি একের পর এক লাশের, যন্ত্রের কাতার। ভেতর থেকে দরজা শক্ত করে এঁটে খিল তুলে রেখেছি মগজে।
এখন শুধুই অপেক্ষা। একটা কড়া নাড়ার। তাহলেই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে ঠুনকো অচলায়তন।
অবনী, বাড়ি আছ?
লেখক: ব্লগার, সঙ্গীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী