কাউকে হিউমিলিয়েট করার অধিকার কারো নেই
প্রকাশ | ২৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:২৩
বাংলাদেশের জান্নাতুন নাঈম প্রীতি'কে গত পরশুর আগে অব্দি আমি চিনতাম না। অনিকেত আমায় হোয়াটস অ্যাপে একটা লিঙ্ক পাঠায়। লিঙ্ক খুলে তো আমি অবাক! একজন মানুষকে যে এইভাবে গণহারে পাব্লিক শেমিং করা যেতে পারে, তা আমার ধারনার অতীত ছিলো! অবাক করা বিষয় হলো, অনেকেই অত্যন্ত অসভ্য এবং বাজে ভাষায় মন্তব্য করছিলো! তারপর বন্ধুতালিকায় থাকা কিছু বাংলাদেশী মানুষের অত্যন্ত অভদ্র এবং নোংরা ভাষায় ভরা পোস্ট দেখলাম তাকে নিয়ে। প্রচন্ড আহত হয়েছি এসব দেখে।
এবারে আসি প্রীতি'র অপরাধ (!) যা নিয়ে এত হৈচৈ, সেটাতে। প্রীতির পোস্টটা ছিলো ইমতিয়াজ মাহমুদ (যাকে বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী এবং একজন মুক্তচিন্তক এবং নারীবাদী লেখক বলে জানতাম), নিজের বউয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো নয়, এবং তিনি একা এসব বলে তার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান, তারপর প্রতারণা করেন এবং এর সাপেক্ষে সে তার এবং ইমতিয়াজ মাহমুদের চ্যাটের কিছু স্ক্রিনশট দেয়। এবং এটাও লেখে যে অন্য কোনো মেয়ে যাতে এর প্রতারণার শিকার না হয়!
গত দুদিনে প্রীতির প্রোফাইল, লেখালেখি, তাকে নিয়ে অন্যদের লেখালেখি, সব পড়ে এবং দেখে বলছি, একটা মেয়ে বা ছেলে যেই হোক না কেন, সে কার সাথে প্রেম করবে সেটা তার নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষ হিসেবে তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে যে কোনো কারোর সাথে প্রেম করার বা না করার! সেখানে সে কেন এত বয়স্ক একজনের প্রেমে পড়লো এই প্রশ্ন তোলার আপনাদের কারোর কোনো অধিকার নেই স্যার/ম্যাডাম! আদিরসে পরিপূর্ণ মন্তব্য করারও কোনো অধিকার নেই!
প্রীতি, একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। মানুষ। যার আপনাদের সবার মতো রাগ, ক্ষোভ, প্রেম ,ভালোবাসা, ঘৃণা পায়। হয়তো বয়সের অপরিপক্কতার কারনে অথবা চূড়ান্ত রাগে সে ফেইসবুকে সবার সামনে ওইভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে স্ক্রিনশট দিয়ে! অপরিপক্কতা বা রাগ এইজন্যে বলছি, কারন সে বুঝতে পারেনি ফেইসবুক একটা শুয়োরের খোয়াড়! এখানে কারোর ইমোশনের কোনো দাম নেই! এখানে প্রতিমূহূর্তে মানুষকে বিশেষত মেয়েদের কিভাবে হিউমিলিয়েট করা যায় তার চেষ্টা চলে! এবং আশা করি প্রীতি এইবার এটা হাতে কলমে বুঝতে পেরেছে আপনাদের কল্যাণে!
এখন যদি ধরেও নেই প্রীতির ভুল হয়েছে, তাহলেও তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? তার চরিত্র নিয়ে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে? এই চুড়ান্ত পাবলিক শেমিং দেখে আমার মনে হয়েছে, যদি ফেসবুক না হয়ে সামনাসামনি কথা হতো আপনারা হয়তো প্রীতির গায়েও হাত তুলতেন!
অন্যান্য মানুষের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু যেসব স্বঘোষিত মানবতাবাদীরা মেয়েটাকে এত নোংরা আক্রমণ করছেন, একজন মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসাবে উচিত ছিলো তো এইসময়ে মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো! যদি মনেও হয় ব্যাক্তিগত চ্যাটের স্ক্রিনশট দেওয়া তার ঠিক হয়নি, সেটা তাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলা। কিন্তু সেটা না করে তাকে যতটা হিউমিলিয়েট করা সম্ভব, আপনারা তার চেয়েও বেশি করেছেন!
আজ ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের চিনি নিচ্ছি সেই মুখগুলো হিসেবে, যারা ধর্ষণের পর মেয়েদের পোষাকের দোষ খুঁজে। আমি আপনাদের চিনে নিচ্ছি সেই পুরুষতান্ত্রিক গাম্বাট হিসেবে যারা জন্মের পর থেকে মেয়েদের মাথায় ঠেসে গুজে দেয়, কেউ তাদের সাথে অসভ্যতা করলে, ঠকালে, প্রতারনা করলে তা চুপচাপ চেপে যেতে এবং শুধু ইগনোর করে যেতে। প্রয়োজনে সোস্যাল মিডিয়ায় আসা বাদ দিয়ে দিতে! কিন্তু মুখোশগুলো যেন টেনে ছিঁড়তে না যায়! মেয়েরা প্রতারিত হলে তাতেও দোষ মেয়েদেরই থাকে! প্রীতিকে আক্রমণ করতে গিয়ে আপনাদের এই স্বরূপটা সবার সামনে এসে গেল স্যার/ম্যাডামগণ!
প্রীতি কেন ইমতিয়াজ মাহমুদের প্রেমে পড়েছিলো সেই প্রশ্নেই আমি যাবো না! কারন প্রেম একজন মানুষের একান্ত ব্যাক্তিগত ফিলিং! সেখানে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার আমার নেই। আপনাদেরও নেই। সে কেন ব্যাক্তিগত চ্যাটের স্ক্রিনশট দিলো সেটা নিয়েও কোনো প্রশ্নে যাবো না, কারন ওইসময় ওর মনের অবস্থা কি ছিলো সেটা সম্পর্কেও আমার কোনো ধারনা নেই। আপনাদেরও নেই। শুধু একজন মেয়ে হিসেবে আরেকজন মেয়ের প্রতি হওয়া এহেন পৈশাচিক ব্যাক্তি আক্রমনের তীব্র প্রতিবাদ করছি! মানুষ হিসাবে আরেকজন মানুষের প্রতি হওয়া এহেন অমানবিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছি! একজন মানুষকে এভাবে হিউমিলিয়েট করার কোনো অধিকার কারোর নেই।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট