স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আমায় ডেকো
প্রকাশ | ২২ জুলাই ২০১৬, ১৩:০১
কোনো কোনো মানুষ আছে যাদেরকে ভোলা যায় না। মনের ভেতরের কোথায় যেন তারা নিজেদের একটি পাকা অবস্থান তৈরি করে নেন। এই প্রসঙ্গে লালন ফকিরের একটি গান মনে করা যায়।
"তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা,
মন জানো না।
তোমার মনে বসত করে কয়জনা।"
আসলেই মানুষের মননের এবং চৈতন্যের ঘরটি বিশাল এবং বিস্তৃত । এই ঘরে যে কতজন বাস করে তার হিসেব নিকেশ করা যায় না। কিছু কিছু মানুষ মনের ঘরে বসবাস করেন ঢাকঢোল পিটিয়ে আর কিছু কিছু মানুষ থেকে যান নীরবে নিভৃতে।
সেই রকম একজন অনুপম সঙ্গীতজ্ঞ লাকী আখন্দ। সঙ্গীত তার জীবনের একটি বড় এবং একমাত্র অধ্যায়, যে অধ্যায়টি আমাদের জীবনের ভাললাগার এবং ভালবাসার জগতটাকে একরকম সুরমূর্চ্ছনায় ছুঁয়ে দিয়ে এক ধরনের মেলোডিয়াস জগতের মধ্যে আবিষ্ট করে আছে।
আমরা যখন তরুণ অবস্থায় নানা রকম গানের সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে, পাগল হয়ে, নিবিষ্ট হয়ে শুনে শুনে একটি স্বপ্নাবিষ্ট ভালবাসার জগতে প্রবেশ করছি তখন লাকি আখন্দ আর হ্যাপি আখন্দের গানের পেলব মসৃণ আধুনিক সুরের মূর্চ্ছনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে শিখেছিলাম। বুঝতে শিখেছিলাম 'নীল মনিহার' নামের প্রেম কাউকে উপহার দেওয়া যায়। তখনো জানতাম না প্রেম কেমন, নীল মনিহার কেমন। কিন্তু যখন শুনতাম, "এই নীল মনিহার এই স্বর্ণালি দিনে তোমায় দিয়ে গেলাম শুধু মনে রেখো।"
আমার প্রিয় বান্ধবী কলিই প্রথম গানটির প্রতি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
বলল, "মিনু লাকি আখন্দের গানটা শুনেছো?"
আমি বললাম কোনটা? তখন ও এই গানটির কথা আমাকে জানালো। ওর একটি ভাল অভ্যাস ছিল। পৃথিবীর যেখানে যা কিছু ভাল আছে তা আমাকে জানাতে হবে। তখন রেডিওই ছিল আমাদের জানাশোনার একমাত্র সম্বল। তারপর এসেছিল টু-ইন-ওয়ান। সব ঘরে সেটি ছিল না। ওদের ছিল। মাঝে মাঝে ওদের টু ইন ওয়ানে আমরা এইসব প্রিয় গানগুলো শুনতাম। রেডিওতেও শুনতাম।
এ ছাড়া আরো শুনতাম, "যেখানে সীমান্ত তোমার......,
শুনতাম, "চল না ঘুরে আসি অজানা দেশে, যেখানে নদী এসে মিশে গেছে"। "আবার এসেছে সন্ধ্যা শুধু দুজনে"।
এই গানটি ছিল লাকি আখন্দের ভাই হ্যাপি আখন্দের। দুই ভাইয়ের এই গানগুলো তখনকার সময়ে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তারপর শুনলাম হ্যাপি আখন্দ আত্মহত্যা করেছেন। এর পরে লাকি আখন্দকে আর কোনো নতুন গান গাইতে শোনা যায়নি।
শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির যে কয়টি মাধ্যম আছে সঙ্গীত হল তার মধ্যে অন্যতম সুক্ষ্মতম শিল্প মাধ্যম, যা একেবারে হৃদয়ের কাছের সম্পদ। প্রাণ যেন কথা কয়ে ওঠে সঙ্গীতের অনুরণনে। সঙ্গীতের অসীম ক্ষমতার বলেই বেহুলা নৃত্যগীত পরিবেশনের মাধ্যমে মৃত্যুর হাত থেকে তার স্বামীকে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। অর্ফিয়াস তাঁর সাপের দংশনে মৃত স্ত্রীকে প্রায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন মৃত্যুপুরী থেকে। সঙ্গীতের পক্ষেই অসাধ্য সাধন হয়। সঙ্গীতের মাধ্যমেই আমরা ভালবাসার দীক্ষা পাই। বলতে শিখি,
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।"
সঙ্গীত জগতের এই বিস্ময়কর আত্মনিবেদিত মানুষগুলি ভালবেসে শ্রোতার ভাললাগার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করে যান। সেই আত্মনিবেদিত মানুষদের একজনই হলেন এই লাকি আখন্দ। আমার ছোটবোন সাবিনা শারমিন ছন্দা (বাংলাদেশ বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক) কানাডা থেকে আমাকে ফোন করে বলল: আপা, লাকি আখন্দ এত বড় একজন সঙ্গীতশিল্পী যাঁর গান তোমাদের মুখে মুখে ফিরতো তিনি এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন; চলো তার জন্য কিছু একটা করি। মানুষের প্রতি সংবেদনশীল বোনটির এই বেদনাবোধটুকু আমাকেও তার প্রতি আকুল করে তুললো। সত্যি এক সময় লাকি আখন্দ ও হ্যাপি আখন্দের গান আমাদের কাছে নতুন ধারার গান হিসেবে মুখে মুখে ফিরতো।
আশ্চর্যের বিষয় হল এই গানগুলো এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ জনপ্রিয় গান হিসেবে সঙ্গীত জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই সুর-
"স্মরণের জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আমায় ডেকো। তুমি আমায় ডেকো।
এই নীল মনিহার এই স্বর্ণালি দিনে তোমায় দিয়ে গেলাম। শুধু মনে রেখো।"
এই আকুতিটুকু ভোলা যায় না।
সঙ্গীত জগতের এই কিংবদন্তীকে আমাদের অনেক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই। তার সুস্থতা কামনা করি।
প্রিয় বন্ধুরা অসুস্থ এবং অসহায় এই শিল্পীর প্রতি আসুন আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। আমাদের একমুঠো ভালবাসায় তিনি নতুন জীবন লাভ করতে পারেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা