ভয়েরেস্টিক সমাজ
প্রকাশ | ২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৪৩
আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে সকালবেলা ইমতিয়াজ মাহমুদকে নিয়ে একটা স্ট্যাটাস মহান ফেসবুকে দিয়ে ফেলেছিলাম। এখন এই অপরাধে আমার ইনবক্সে ঘটনা কি তা জানার জন্য হাজারো উৎসুক জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
আমি ভোর ছয়টা ছাব্বিশ মিনিটে ঘুম থেকে উঠেছি, সাড়ে সাতটায় একটা টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে টরটর করে আসছি, এসে একটা মুরগী রান্না করেছি আলু দিয়ে, তারপর মেয়ের স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং এ গেছি। নামেই প্যারেন্টস মিটিং, গিয়ে দেখি সকল মায়েরা উপস্থিত, বাবাদের চিহ্ন নাই। কোন বাবা তার অফিসের জরুরী কাজ ফেলে এই মিটিং-এ আসেন নাই, মায়েরা চাকরি করুক আর যাই করুক তাদের কাজ বাবাদের মতো অত জরুরী না যে তারা আসবেন না, তাই এসেছেন। আমি এইসব ব্যাপারে খুবই স্ট্রিক্ট। সাব্বীর নেহায়েত ঢাকার বাইরে তাই আমি আজ গেছি না হইলে তাকেই যেতে হতো।
ওদিকে রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি না। রিপেট্রিয়েসন অনিশ্চিত। আমাকে ফরেন মিনিস্ট্রির লোহার বাসরঘরের নিশ্ছিদ্রতা থেকে সুতানলী সাপ হয়ে কিছু একটা বের করতে হবে- এটা অফিস এ্যাসাইনমেন্ট।
এর মধ্যেই ইনবক্স টু টু করতেই আছে। ইমতিয়াজ মাহমুদ এর ব্যাপারটা কি? সবার উদ্দেশ্যে ঘটনা এইখানে বলছি। যদিও ইতিমধ্যে ঘটনা ভাইরাল কিন্তু কিছু বিষয় দেখতে দেখতে আমারও বিরাট 'ঘুম পাওয়া'র মতো 'লেখা পাচ্ছে', তাই বলতেই হচ্ছে। বিশেষত ফেসবুকের বিরাট মোরাল পুলিশ বাহিনী যেভাবে তড়পাচ্ছে তাতে আমি রীতিমতো ভীত হচ্ছি এবং পুনঃ পুনঃবার চেক করছি যে আমি কারো সাথে অনৈতিক কিছু করে ফেললাম কি না।
তাছাড়া পপকর্ন হাতে গ্যালারিতে বসে যাওয়া দর্শকবৃন্দর কথাও ভাবতে হয়, যারা "ফেসবুকের মাঠ তো গরম", "তোর কি হবে রে কালিয়া", "তরুনযুবা রাইখা বুড়া ভামদের প্রেমে পড়া কেন" ইত্যাদি ইত্যাদি বলে যাচ্ছেন, এইসব ব্যাক্তিত্বহীনদের বিনোদেন দেখাও তো দায়িত্ব।
বিখ্যাত উনিশ বসন্তে'র লেখিকা, জান্নাতুন প্রীতি কয়েকটা স্ক্রিনশট বাজারে থুক্কু ফেসবুকে ছেড়েছেন। স্ট্যাটাসে তিনি বলেছেন, ইমতিয়াজ মাহমুদের ব্যাক্তিত্বের প্রেমে তিনি পড়েছিলেন, উনি বিবাহিত কিন্তু প্রীতির মনে হয়েছিল, সে একাকী, বেদনাকাতর এক পুরুষ। যাই হোক প্রেম করার পর তাকে অনেক স্বপ্নটপ্ন দেখিয়ে এখন না কি ব্যারিস্টার সাহেব বলেছেন, তিনি এসব মজা করে বলেছেন। মোটকথা তিনি প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন।
এখন স্ক্রিনশটে দুজনের মিউচুয়াল প্রেমালাপ ছাড়া অন্যকিছুই আমি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পেলাম না। আমি খালি পরের শটে যাই চেষ্টা করি খুঁজতে যে ইমতিয়াজ মাহমুদ নামে "বুইড়া ভাম" আর কি কি করেছে। কিন্তু কিছু পাই না।
ইমতিয়াজ মাহমুদ কখনও তিনি কামনা-বাসনা রহিত বলেছেন বলে আমার মনে পড়ছে না। তার কোন পোস্টে এরকম কিছু তো চোখে পড়ে নাই, তিনি সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে পোস্ট দেন, পাহাড়ীদের জন্য তার বিশেষ দরদ আছে, নারীবাদ সমর্থন করেন- এর সাথে তার ব্যক্তিগত প্রেম-অপ্রেমের সম্পর্ক কি?
জ্বী একটা সম্পর্ক আছে। 'প্রিয়তমা স্ত্রী' বলে প্রায় প্রতিদিনই একটা করে তেলতেলে পোস্ট তিনি দেন যাতে প্রমাণিত হয় তিনি বিরাট সুখী মানুষ। তো এই বিরাট সুখী মানুষ কেন হঠাৎ প্রেম করতে যাবেন? এসব কিছুর পরেও কেউ প্রেমে পড়তেই পারেন সেই মহাকাব্যে গেলাম না, একটা কোয়েরি খালি, উনি প্রতারণাটা কোথায় করলেন? দুইজন মানুষের মিউচুয়াল সম্পর্ক একসময় তো ভাঙতে পারেই- কোপানো বদরুল এবং কোপানো প্রীতিরা এটা কেন মানবে না?
যাই হোক, বন্ধুগণ, সারাদিন অনেক দেখলাম। অন্যের সঙ্গম হঠাৎ করে দেখে ফেলার মতো অস্বস্তি, লজ্জ্বা এবং খানিকটা ঘেন্নাও হচ্ছে। আমি আসলে আগে যা যা লিখলাম, লিখলাম যে "লেখা পাচ্ছে তাই লিখছি" এসব মিথ্যা, এসব গিমিক। আমি আসলে যা বলতে চাই তা হলো, এই ঘটনা থেকে আমি আরও একবার অসম্ভব ঈর্ষাকাতর, হাততালিপ্রবণ, বৃত্তাবদ্ধ, ভয়েরিস্টিক, (শব্দটা আমার মওলায় শিখিয়েছেন) মেয়ের বয়সী নারী বা বাবার বয়সী লোকের সাথে বা ছেলের বয়সী পুরুষ অথবা মায়ের বয়সী নারীর সাথে প্রেম করা যাবে না শীর্ষক নৈতিক শিক্ষাদানকারী আমার সমাজকে দেখলাম। প্রেম এবং প্রেম ভেঙে যাওয়া এই সমাজে ধরা খাওয়া হিসাবে গণ্য হয়।
নারীবাদ মানে সমতার লড়াই, মানুষে মানুষে সমতা, মানুষ- সে নারী হোক বা পুরুষ করতে পারে অন্যায়- এটা মানতে না পারা, এইটুকু বুঝতে না পারা আরো কিছু বলদ নারীবাদীকে আরো একবার চিনলাম। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নীতি নৈতিকতার সাপ্লাইকারীদের চিনলাম। এবং বুঝলাম যে নারীবাদ এ অঞ্চলে এক ভয়ংকর অপরাধের নাম। সবাই অধীর অপেক্ষায় থাকে, নারীবাদী-পুরুষ হোক বা নারী- ক্রুদ্ধ, হিংস্র সমাজ তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তমাংস পান করতে উদগ্রীব থাকে। তাই যেকোনো গালির আগে যুক্ত হয়, 'নারীবাদী'।
আমি এই ঘৃণা বারবার টের পাই। আমি সূর্যের আলোয় দেখি চকচক করে ওঠে ঘৃণা আর বিদ্রূপের ছুরি। আমার ঘাড়ের কাছে হাত রেখে, আমার পিঠের পরে চোখ রেখে আমি হাঁটি। এই ঘৃণাকে জয় করে, এই জাহান্নামের আগুনে বসে পুস্পের হাসি হাসাই আমার এবং আমাদের কারোর কারোর সারাজীবনের সংগ্রাম।
লেখক: সাংবাদিক