আপনার বয়স কত?
প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৫৪
আমার এই মুহূর্তে ৩৩, আসছে এপ্রিলে ৩৪ হবে ইনশাআল্লাহ। আমি যে বছর ২২ হলাম, তখন আমার বাবার বয়সী বসকে গিয়ে বললাম, আমার বেশ মন খারাপ। উনি জিজ্ঞেস করছিলেন, জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার অনুভূতি কি? আমার কথা শুনে কারণ দর্শালেন, আমি দিব্যি সিরিয়াস মুখ করে বলছি, এই দেখো না, কেমন বুড়ো হয়ে গেলাম! উনি আমার দিকে বেশ চোখ উল্টে তাকালেন, আমি এতটুকু মেয়ে কিনা উনাকে বলছি যে আমি বুড়িয়ে গেছি সে বাইশেই!
উনার চোখ উল্টোনো দেখেই কিনা জানি না, আমি পরে ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভাবতে বসলাম। আমার আসলেই ভালো লাগছিলো না আমার বয়স বেড়েছে, কিন্তু আসলেই তো, ২২ বছর বয়সে অমন লাগবে কেন? সেটা কি স্বাভাবিক? আশপাশে তাকালে তো অবশ্য দেখি স্বাভাবিক। ডবল ডিজিটে বয়স যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাচ্চারা হিসেব কোষে - আমার বয়স ৩ বছর ৪ মাস ৫ দিন, যেন ৪ বছর হতে তার আর তর সইছে না! কিন্তু সে বাইশেও সমবয়সীদের মাঝে দেখেছি, আর এখনো সব রকম বয়সেই দেখি, জন্মদিনে সবার বেশ মন খারাপ হয়ে যায়, - "বুড়ো হয়ে গেছি", তাই!
তো, সেই বাইশে যখন ভাবতে বসলাম, এমনটা বোধ হচ্ছে কেন, তখন বুঝলাম, আমি আসলে মনমরা হচ্ছিলাম বয়সের ক্যালেন্ডারের পাতাটি উল্টোবার জন্য নয়, আমার আসলে তখন মনে হচ্ছিলো আমার স্বপ্নগুলোর থেকে বেশ দূরে ছিটকে পড়েছি। আমার সহপাঠীরা অনেকেই ব্যাচেলারস শেষ করলো সে বছর, বা পরের বছর করার জন্য প্রস্তুত; - আর আমি তখন ফুলটাইম কাজ করছি, পার্টটাইম যাচ্ছি কলেজে, কবে কি শেষ হবে বুঝতে পারছি না। পাশ করার পরপরই কেউ কেউ বিয়ে করলো, বা মনে হচ্ছে অনেকেই তাদের বয়ফ্রেন্ড কি গালর্ফ্রেন্ড নিয়ে সুখী, - আর এদিকে তার কিছুদিন আগে আমার প্রথম প্রেম এসে বলে গেছে, "অনেকদিন তোমার সাথে কথা হয় নাই, কিন্তু বলতে এলাম, সামনে আমার বিয়ে, দোয়া করো আমাদের জন্য!" আমি তখন মাঝে মাঝেই কাঁদি, এমন কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই সে মুহূর্তে যে বলে হালকা হবো, (তাছাড়া, অনেকদিন পর্যন্ত খুব বেশি চাপা স্বভাবের ছিলাম, নিজের মনখারাপের কথাগুলো খুব কাছের মানুষকেও বলতাম না)। পরিচিত অনেকেরই দেখছি ক্যারিয়ারটা দারুন গতিতে চলছে, আর এদিকে আমি? যে লাইনে চাকরি করি, সেটা মনের তাগিদে নয়,- সংসারের খরচের কিছু ব্যাপার আছে, আর সেই সঙ্গে এটি অভ্যাসও হয়ে গেছে, - কোম্পানিটা নামকরা, বস আমার ভালো, চাকরিটা মনমতো হলেই কি, না হলেই কি, - একটা কিছু হাতে আছে তো! চলছে যখন, চলুক!
তো, ঐ বাইশে যেদিন আমার মনে হলো, ওহ আচ্ছা, আমার আসলে বয়স নিয়ে মন খারাপ না, আমার সমস্যা হচ্ছে আমার স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাওয়া দেখতে, সেদিন থেকে আমার মনে হলো, - তাহলে আর বয়স নিয়ে ভাবা কেন? মূল যে সমস্যা, সেটা ঠিক করে ফেললেই হয়! স্বপ্নগুলোর পেছনে ছুটবো, 'সিম্পেল'!
বলিউড কি হলিউড সিনেমা হলে সেই টার্নিং পয়েন্টটা থেকে আমি এতদিনে বিল গেটস হয়ে যেতাম, - সত্যিকার জীবনে ঠিক সেভাবে হয় নাই। আরো কিছু জিনিস বুঝতে আমার সময় লেগে গেলো, কিন্তু সেদিন থেকে যেটা আমি ঠিক করে ফেললাম, আমি আর কক্ষনোই বয়স বাড়া নিয়ে মন খারাপ করবো না, সেটার মতো বোকামি আর কোন কিছুতে হয় না! জীবনের প্রত্যেকটা বছরই তো স্রষ্টার থেকে একটা উপহার, তাই না?
আমার এই ফিলোসফিটার কথা আমার এক বান্ধবীকে বলেছিলাম এইভাবে, - বয়স না বাড়া মানে কি? তার মানে আমি কবরে, তাই না? তার থেকে বয়স বেড়ে যাওয়াটাই কি ভালো না, অন্তত, তার মানে, টাইম আপ এখনো হয় নাই!
তো, বন্ধুগণ যেমনই ভাবুক, আমি সেই থেকে আমার নিজের প্রত্যেকটা জন্মদিন খুবই আনন্দের সাথে উদযাপন করি, সেটা একাই হোক, কিংবা কাছের মানুষদের নিয়েই হোক। আর সেই উদযাপনটি কখনো একটা দিনে শেষ হয় না; অর্থাৎ, আমার মনোভাবটা এমন হয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটা দিন আমি চাই খুব চমৎকার হোক, খুবই আনন্দ আর উৎসাহে আর উদ্দীপনায় বেঁচে থাকা হোক, - না হলে আর জীবন কি? তার মানে এই না, কোন কোন দিন বোরিং হবে না, কষ্টের হবে না; তার মানে এই না, মিছেমিছি সুখের অভিনয় করতে হবে, - কিন্তু তার মানে এই, প্রত্যেকটা দিন হবে জীবনের সেলিব্রেশন, স্বপ্নগুলোকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরা, কখনো মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে ফের আবার উঠে দাঁড়ানো, ঘুরে দাঁড়ানো, - আবার ফের আকাশ পানে দৌড়ে যাওয়া!
আর, আমি ঠিক করে ফেললাম, আমি আর কখনোই আমার বয়স লুকোবো না। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় হয় না এমন? আমরা কখনো বয়স বলি না। একটা নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে গেলেই (মধ্য কুড়ি থেকেই বোধ করে শুরু হয়) গায়ে একটি তকমা আটকে যাওয়া: এই বয়সে এমনটা করতে নেই, এই বয়সে এই করে ফেলা উচিত, এই বয়সে এখনো ওটা হয়নি, তুমি তো তাহলে ব্যর্থ জীবনে! আর ছেলে মেয়ে উভয়েরই বেলায়, আমাদের মনে একটি ধারণা তৈরী হয়ে যায়, অমুক বয়সটা পেরিয়ে গেলেই সে বুঝি আর 'কুল' থাকলো না, এখন সে আসলেই বুড়িয়ে গেছে! -আর সেই অমুক বয়সের মাপকাঠিটাও বয়সের ভেদেই প্রায়শই পাল্টায়!
আমি একটা মজার স্মৃতি কখনোই ভুলবো না, এক জুনিয়র বান্ধবীর সাথে লাঞ্চ করছি, সে বেশ বিরক্তস্বরে বলছে, তিরিশ বছর বয়সীদের আমি দুই চোখে দেখতে পারি না, উফফ!! এদের কি কি সব সমস্যা রে বাবা, সারাক্ষণ এই করো না, ঐ করো না, খাটাশ বুইড়া একেকজন! ... এটি তিন বছর আগের ঘটনা, আমি হেসে বললাম, তুমি কি জানো, আমার বয়স তিরিশ?? আমার সেই জুনিয়র বান্ধবীর চমকে যাওয়া চেহারাটি ভাবলে এখনো হাসি লাগে, - সে মাফ চেয়ে বলে, স্যরি, আমি আসলে তোমাকে কখনো বুড়ি ভাবি নাই, কিন্তু আমি আসলেই ভাবতাম তিরিশ মানেই বুড়ি!
আমি ভেবে দেখলাম, সে ভাববে না কেন এটি? আমরা যদি একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর আমাদের বয়স জানানো বন্ধ করে দেই, আর সেটি যখন করি বয়স বাড়ার এই তুমুল দুঃখবোধ থেকে, - তখন আমাদের মাথাতে বদ্ধমূল হয়ে আটকে থাকে, তারুণ্য মানেই বুঝি কেবল সুকান্তর সেই আঠারো! বাকি আর সব বয়স মানেই বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া, যে বার্ধক্যে কোন স্বপ্ন নেই, কোন স্পৃহা নেই, কোন আনন্দ কি উৎসব থাকে না! - কিন্তু এমনটা কি হতেই হবে বুঝি? আমি তিরিশে শুরু করেছি ফেসবুকে পাবলিক লেখালেখি, টুকটাক পেয়েছি বাংলাদেশে পরিচিতি; ৩১শে আমার প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে পেয়েছি পরিতৃপ্তি আর ঊর্দ্ধমুখী গতি; ৩২শে শুরু করেছি কিকবক্সিং, - আর ৩৩শে জড়িয়ে গেছি আমেরিকান এক্টিভিজম নিয়ে, যে সুবাদে ডালাসেও কেউ কেউ চিনেছে আমায় এখন, সামনে আরো ফলপ্রসূ কিছু করবার ছক কষছি কেউ কেউ মিলে।
আমি মানি যে আমার জীবনের প্রাধিকার অনেকদিকে অনেক অনেক বেশি; - কিন্তু আমি এটাও মানি, যদি বাইশের সেই মন খারাপের কাছেই হার মেনে যেতাম, তাহলে হয়তো তিরিশে আমিও বার্ধক্য মেনে জীবনের ভারেই নুয়ে যেতাম বুঝি। আমার এখনো আমার সমবয়সীদের অনেক সামাজিক প্রাপ্তি হতে পারে নেই, কিন্তু সফলতার মানে যদি হয় খুব আনন্দ নিয়ে স্বপ্নের পেছনে ছোটা, সেই সঙ্গে কিছু কাছের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত থাকা, - তাহলে হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ, আমি কৃতজ্ঞ, সেই অর্জনটি আমারও আছে।
আর যতদিন স্রষ্টা দিয়ে যাবেন একেকটি দিন, মাস, বছর, - ততদিন আমার সফলতার মাপকাঠি আমার মতো করেই গড়তে যাওয়ার সাধটিও আমার অনেক, অনেক বেশি। তা, যা হোক, যা বলছিলাম, - আমার বয়স ৩৩, এই এপ্রিলে হবে ৩৪, - আপনার দেহঘড়ির বয়সটি এইবার কত হলো, শুনি?
লেখক: লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট